স্বপ্নের লাদাখ ভ্রমণ- ন্যাড়া পাহাড়ের টানে (পর্ব ৭)

ভোর ৪ঃ৫০ এর দিকে ঘুম ভেঙে গেল। আমাদের বাস আম্বালার কোন একটা পেট্রোল পাম্পে তেল নিচ্ছিল তখন। আমিও এই সুযোগে গাড়ি থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে নিলাম, আমার দেখাদেখি আরও কয়েকজন। তেল নেয়া শেষে গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো, আধো আলো-অন্ধকারে ভোরের শহুরে সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। রাস্তায় ফ্লাইওভারের কাজ চলাতে মাঝে মাঝেই গাড়ি থেমে যাচ্ছিল। নিরব নিস্তব্ধ শহরের ইট পাথরের অট্টালিকা পেরিয়ে সুবুজ প্রান্তরে ছুটে চলেছি। এবার কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি।

সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে ঘুম ভাঙ্গে গিন্নীর ফোনে। গাড়ি ততক্ষণে কোন এক অজানা পাহাড়ী এলাকায় ছোট একটা জ্যামে দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিকে ঝলমলে রোদ, নীল আকাশ আর পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য সব মিলিয়ে একটা সুন্দর দিনের শুরু। এসি বাস না হলে নিখাদ প্রকৃতি আর বিশুদ্ধ বাতাস সরাসরি গায়ে মাখিয়ে অনুভব করা যেত। সবাই সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তায় বাস জার্নি উপভোগ করছিলাম।

সকাল সাড়ে আঁটটার দিকে হালকা হওয়ার জন্য কিছু সময়ের জন্য বিরতি দেওয়া হয় পাহাড় আর সবুজে ঘেরা এক নাম না জানা জায়গায়। প্রথমে নামবো না ভেবেছিলাম, কিন্তু এমন পরিবেশে সামান্য সময় হেটে বেড়ানোও সৌভাগ্যের। আশেপাশে কোন লোকালয় নেই, শুধুই নীরবতা। মাঝে মাঝে সেই নীরবতা ভেঙ্গে দিচ্ছে কোন পাখির মিষ্টি ডাক। এবার নীরবতা ভেঙ্গে দিচ্ছে গাড়ির হর্ন, গাড়ি ছেড়ে দিবে। এদিকে যে কাজের জন্য গাড়ি থামালো সেই আসল কাজের কথাই ভুলে গেছি। কোনমতে শেষ করে গাড়ির শেষ যাত্রী হিসেবে গাড়িতে উঠি। সবাই আমার দিকে কেমন যেন তাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছে এই দুই মিনিটে গাড়ি ৩০ কিলোমিটার চলে যেত। আর আমি সেই কাজে একমাত্র বাধা।

দেশে থাকলে হয়তোবা আরো সুন্দর হতে পারতো দিনটা, কারণ রোজার ঠিক আগে বিয়ে করে বউ বাড়িতে রেখে এসেছি। বিয়ের পরে এইটা ছিল আমাদের প্রথম ঈদ, কিন্তু আমরা দুইজন দুই দেশে। আসলে কিছুই করারও ছিলনা, আমার বিয়ের আরো চার মাস আগেই এই ট্যুরের বিমান টিকিট কাটা ছিল। আমি না আসলে এত অল্প সময়ে নতুন একজন মেম্বার খুজে পাওয়া কষ্ট হয়ে যেত সবার অথবা ট্যুরই বাদ হয়ে যেতো। বাড়িতে সবাই বলেছিল ট্যুর ক্যানসেল করতে, কিন্তু সম্ভব হয়েছে তার স্যাক্রিফাইসের কারনে। যার জন্য তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাচ্ছি না।

যাই হোক ২০১৭ সালে এমনই রোজার ঈদের দিনে আমি শিমলা থেকে মানালিতে যাচ্ছিলাম। আজও ভাগ্যবশত রোজার ঈদের দিন। সবারই একটু মন খারাপ এই জন্য যে, ঈদের নামাজ পড়া হবে না। সকাল নয়টা বেজে যাচ্ছে কিন্তু নাস্তার বিরতি দেওয়ার কোনো নামগন্ধ নেই। এদিকে ক্ষুধায় আমার অবস্থা কাহিল, ঈদের দিনের ক্ষুধা মনে হয় একটু বেশিই লাগে। ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলে বলেন আরো অনেক পরে বিরতি দেওয়া হবে এখন না। ঠিক সকাল দশটায় হিল স্টার এসি রেস্টুরেন্ট নামক একটা হাইওয়ে ধাবা তে ২০ মিনিটের বিরতি দেয় নাস্তা করার জন্য।

ফ্রেশ হয়ে রুটি আর ডাল দিয়ে নাস্তা শেষে এক গ্লাস ঠান্ডা লাচ্ছিতে চুমুক দিতেই লম্বা জার্নির ক্লান্তি নিমিষেই দূর হয়ে যায়। ঈদের দিনে যাতে মিষ্টিমুখ থেকে বঞ্চিত না হতে হয় সেজন্য নানী দেশ থেকে তার স্পেশাল সেমাই রান্না করে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার ভুলের কারণে সেগুলো আমার ব্যাগে রয়ে গেছে, যা কিনা গাড়ির বক্সে আছে। সকাল সকাল খেতে পারলে মনকে একটু সান্ত্বনা দেওয়া যেত, আল্লাহ জানেন সেগুলো কি নষ্ট হয়ে গেল কিনা !! গুগল ম্যাপ অনুযায়ী আমরা মানালিতে পৌঁছাব আনুমানিক বিকেল তিনটার দিকে, তার মানে প্রায় ৩ ঘন্টা লেট করে। যা সত্যিই খুব হতাশার। এর আগের বার আমি যখন মানালি থেকে দিল্লিতে ফিরে আসি তখন ঠিক ১৪ ঘণ্টা সময় নিয়েছিল HRTC এর বাসে।

বিরতি শেষে বাস আবার চলতে শুরু করে আঁকাবাঁকা ঢেউ খেলানো পাহাড়ি রাস্তায়। বাইরে হাস্যজ্জল রোদের তাপ মনে হয় একটু বেশিই, কারণ এসি বাসে বসে আছি তারপরও গরম অনুভব হচ্ছিলো। কখনো পাহাড়ি নির্জনতা, কখনো বা বাজরের কোলাহল, কখনো শুকিয়ে যাওয়া যৌবন হারা নদী, কখনো বা যৌবনে পরিপূর্ণ ছুটে চলা নদী ছিল আমাদের সঙ্গী। একে একে বিলাসপুর, সুন্দর নগর, মান্ডির মত বড় বড় শহর পেরিয়ে যাচ্ছে, সাথে নাম-না-জানা ছোট ছোট শহর এবং গ্রাম। মান্ডির পর থেকে আমাদের সঙ্গী হিসেবে যোগ হয় খরস্রোতা বিয়াস নদী। যত সামনের দিকে আগাচ্ছে দুই পাশে পাহাড়ের সারি বড় থেকে আরো বড় হচ্ছিল। পাহাড় গুলো আর আমাদের মধ্যে দূরত্ব কম থাকায় নীল আকাশটা অনেক ছোট মনে হচ্ছিল।