ভ্রমণ ডায়েরী

Home News Contact About

ইলিশের বাড়ি চাঁদপুরে ডে ট্রিপ

Lanavola

চাঁদপুরের ত্রিমোহনার নাম অনেক শুনেছি কিন্তু কখনো যাওয়া হয় নি। হালিম ভাই যাওয়ার প্রস্তাব দিতেই আমি রাজি হয়ে গেলাম। যদিও আমাদের যাওয়ার প্ল্যান প্রথমবার মুখ থুবড়ে পড়ে। সোমবার সকালে কক্সবাজার ট্যুর শেষ করে আসলাম আর সন্ধায় হালিম ভাইয়ের মেসেজ বুধবারে চাঁদপুর যেতে হবে ডে ত্রিপে। আমি দ্বিতীয়বার না ভেবে রাজি হয়ে গেলাম। যেহেতু আমি আশুলিয়া থেকে সদরঘাট যাবো তাই হালিম ভাই আমাকে খিলগাঁও হয়ে যেতে বললেন, কারণ খিলগাঁও থেকে রাফসান ভাই যাবেন। সকাল ৬ টায় চাঁদপুর যাওয়ার প্রথম লঞ্চ ছেড়ে যাবে। তাই আমি রাত ৩ টায় ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে মেইন রোডে চলে আসি। ০৩ টা ২০ এ খিলগাঁও হয়ে যাবে এমন একটা বাসে উঠে পড়ি।

Lanavola

ফাঁকা রাস্তায় ৪০ মিনিটের মধ্যেই আমি খিলগাঁও ফ্লাইওভারের নিচে পৌঁছে যাই, ভাড়া ৮০ টাকা। হালিম ভাইকে মেসেজ দিলে আমার কাছে আশেপাশের ভিডিও করে পাঠাতে বলেন। ভিডিও পাঠালে মেসেজে রাফসান ভাইয়ের ভয়েস মেসেজ আসে কিভাবে আমাকে খিলগাঁও তালতলা মার্কেটে আসতে হবে সেই ইন্সট্রাকশন সহ। আমি কিছুটা অবাক হই রাফসান ভাইয়ের ভয়েস মেসেজে, আমার ধারণা হালিম ভাই রাফসান ভাইকে আমার মেসেজ ফোরোয়ার্ড করছেন আর রাফসান ভাই হালিম ভাইকে যে মেসেজ দিচ্ছেন সেটা আমাকে ফরোয়ার্ড করছেন। রাফসান ভাইয়ের কথা মত আমি ৫-৭ মিনিটের মধ্যে তালতলা মার্কেট চলে আসি আর একটা চায়ের দোকানে চা খেত খেতে তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। যেহেতু চারিদিকটা অনেক নির্জন তাই চায়ের দোকানটা আমার জন্য নিরাপদ মনে হল। পরে জানতে পারলাম হালিম ভাই রাফসান ভাইয়ের বাসায় ছিলেন রাতে।

Lanavola

ফজরের আজান হলে আমি মসজিদে নামাজ পড়তে যাই, এসে দেখি হালিম ভাই আর রাফসান ভাই দুইজনই আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। একটা সিএনজি নিয়ে ১৫০ টাকা ভাড়ায় পৌঁছে যাই লালকুঠি ঘাটে। “ইমাম হাসান” লঞ্চ ছাড়তে তখনও পৌনে এক ঘণ্টার বেশি সময় বাকি, আমরাই মনে হয় প্রথম যাত্রী। লঞ্চে উঠে ফটোসেশন করে কিছুটা সময় কাটালাম। হালকা অন্ধকারে বুড়িগঙ্গায় ভোরের স্নিগ্ধতা অনুভব করছিলাম। কয়েকটা লঞ্চ বরিশাল থেকে এসে ভিড়ছে মাত্র। লঞ্চে কোথাও যাওয়ার উদ্দেশে সদরঘাট আসলাম ৯ বছর পর, চিত্রটা খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। যাত্রী আর হকারদের আনাগোনায় মুখরিত চিরচেনা সদরঘাট। সূর্য মামা পূব আকাশে আরকেটি দিনের শুরু করবে সেই অপেক্ষায় লাল রূপ ধারণ করেছে।

Lanavola

ঠিক সকাল ৬ টায় লঞ্চ ছেড়ে দিলো, আমরা ডেকে বসে নদীর মনোরম হাওয়া গায়ে মাখছি। শহুরে পরিবেশ পেরিয়ে দুইপাশে নিখাদ প্রকৃতির আবির্ভাব। আকাশে হালকা মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্য তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছিলো। সকালের নাস্তা করতে ক্যান্টিনে চলে যাই, ব্রেড অমলেট সাথে সস। নাস্তা শেষে রং চায়ে চুমুক দিতে দিতে আবার ডেকে চলে যাই। চা আর নিখাদ প্রকৃতি পারফেক্ট কম্বিনেশন, খরচ ১৮০ টাকা।

Lanavola

নদীর বিশুদ্ধ বাতাস যেখানে কোন দূষণের কোন ছোঁয়া নেই, এমন কিছু পেলে বুক ভরে নিশ্বাস নেয়া যায়। বুরিগঙ্গা নদী পার হয়ে আমরা ধলেশ্বরী নদীতে ভেসে চলেছি। একে একে পাগলা, ফতুল্লা, বক্তাবলী ফেরি ঘাট পেরিয়ে আমরা মুন্সিগঞ্জ পৌছাই। সবথেকে অবাক হয়েছি এখানে এসে, চলতি লঞ্চ থেকে যাত্রী নেমে যাচ্ছে আর নতুন যাত্রী উঠছে আর একটা ছোট ইঞ্জিন চালিত নৌকা থেকে। মুন্সিগঞ্জ পেরিয়ে বেশ কিছুদূর পর আমরা মেঘনা নদীতে প্রবেশ করি, আর নদী তার ছোট থেকে বিশালতার ছবি তুলে ধরতে ব্যস্ত হয়ে পরে।

Lanavola

ঢেউয়ের মাত্রা আগের থেকে বেড়েছে সাথে নির্মল বাতাসের গতিও। দুরের শহর বা গ্রামগুলোর কিছুই প্রায় দেখা যায় না, শুধু মাত্র একটা রেখার মত কিছু একটা বুঝা যায়। ছোট ছোট মাছ ধরার নৌকা নিয়ে মাঝি মাছ ধরায় মগ্ন আপন মনে। কিছুক্ষণ পরপর বালি ভর্তি ট্রলারগুলো পানির নিচে প্রায় নিমজ্জিত অবস্থায় ভেসে চলেছে আপন ঠিকানায়। এই পরিবেশ যেন এক নেশার মত, আপনি চাইলেও চোখ ফেরাতে পারবেন না। সামনেই প্রমত্ত পদ্মা দেখা যাচ্ছে, উত্তাল ঢেউ যেন দুর্বার এক তরুন। পদ্মা আর মেঘনা এখানে মিশে একাকার। তবে পানির ঘোলা রং আর প্রকাণ্ড ঢেউ দেখলে সহজেই আলাদা করা যায় এটা পদ্মা।

Lanavola

চাঁদপুরের কাছে চলে আসাতে নিচে চলে যাই টিকেট কাটতে, জনপ্রতি ১০০ টাকা। নিচে থেকেই দেখছিলাম কিভাবে পদ্মা আর মেঘনা মিশে একাকার হয়ে গেল। চাঁদপুর টার্মিনালে আমাদের স্বাগত জানানোর জন্য অপেক্ষা করছেন সৈকত ভাই। লঞ্চ থেকেই তাকে দেখতে পেলাম, নামার সাথে সাথেই উষ্ণ অভ্যর্থনায় আমাদের স্বাগত জানান। টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে একটা অটোতে করে উনি আমাদের নিয়ে গেলেন “ক্যাফে কর্নার” নামের একটা হোটেলে নাস্তা করাতে। পরোটা, তুন্দুল রুটি, ডালভাজি আর ডিমে পারফেক্ট নাস্তা। নাস্তা শেষে এক কাপ গরম গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে কোথায় কোথায় ঘুরব তার পরিকল্পনা সেরে নিলাম।

Lanavola

হোটেল থেকে বেরিয়ে অটো নিয়ে চলে যাই চাঁদপুর বড় স্টেশন, পাশেই চাঁদপুর মাছ ঘাট। ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর এসেছি আর ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ দেখব না এটাতো হতেই পারে না। স্টেশন পেরিয়ে মাছ বাজারে ঢুকে যাই। বাজারে সবাই ইলিশ বেচা কেনা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। ছোট থেকে বড় সব ধরনের ইলিশের পসরা নিয়ে বসে আছেন সবাই। চাহিদা অনুযায়ী পাইকাররা ইলিশ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন এখান থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। পরিমাণ বুঝে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ডাকের মাধ্যমে। কেউ কেউ বাসায় খাওয়ার জন্য তাজা ইলিশ নিয়ে যাচ্ছে অল্প পরিমানে। বাজার পেরিয়ে আমরা মাছ ঘাটে ঢুকে যাই, সেখানে কয়েকটা নৌকা থেকে ইলিশ নামানো হচ্ছে। এই মাছ ঘাটটি ডাকাতিয়া নদীর তীরে অবস্থিত। আমরা দুপুরে খাওয়ার জন্য ছোট সাইজের ২ টা মাছ নিলাম ১ কেজির একটু উপরে, দাম ৪২০ টাকা। মাছ ঘাটের একটা হোটেলে দিয়ে দিলাম, আমার যখন আসবো তখন ভেজে দিবে আর লেজের ভর্তা বানিয়ে দিবে। বিনিময়ে সে নিবে ২০০ টাকা, এ যেন খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি।

Lanavola

বাজার থেকে বেরিয়ে ২ মিনিট হেটে চলে যাই ত্রিমোহনায়। সেখানে পদ্মা, মেঘনা আর ডাকাতিয়া নদীর মিলনস্থল। পানির স্রোত এবং ঘূর্ণি খুবই বেশি এখানে। মেঘনা আর ডাকাতিয়া নদীর পানির রং একই মনে হলেও পদ্মাকে আপনি সহজেই আলাদা করতে পারবেন।

Lanavola

প্রায় ঘণ্টা খানেক পরে আমরা চলে যাই সাহাবুদ্দিন স্কুল এন্ড কলেজে, দূরত্ব প্রায় ৯ কিলোমিটার। এই জায়গাটা সম্বন্ধে আমার কোন ধারনা ছিল না। স্কুলের ভিতরে এখন ঢুকা নিষেধ, তবুও সেখানের একজনকে অনুরোধ করে ভিতরে ঢুকার অনুমতি পাই সামান্য সময়ের জন্য। খোলামেলা পরিবেশে স্কুলটির নির্মাণশৈলী সত্যিই মুগ্ধ করার মত। ইট, বালি, সিমেন্টের পাশাপাশি বাঁশ এবং কাঠের ব্যবহার স্কুলটিকে সত্যিই সুন্দর একটা রুপ দিয়েছে। কিছুক্ষণ থেকে আবার চলে আসি মাছ ঘাটে, মাঝে বিরতি দেই কালীবাড়িতে চাঁদপুরের বিখ্যাত “ওয়ান মিনিটের” আইস্ক্রিম খেতে। আপনি হয়তো অনেক দামি আইস্ক্রিম খেয়েছেন কিন্তু এই আইসক্রিম খেয়ে আপনাকে একবার হলেও ভাবতে হবে এটাই কি আমার খাওয়া সবথেকে স্বাদের আইস্ক্রিম?!! আইস্ক্রিম বিল ১৬০ টাকা সৈকত ভাই পরিশোধ করেছেন। অটো ভাড়া ৩২০ টাকা দিয়ে সেই হোটেলে চলে যাই দুপুরের খাবার খেতে পৌনে ২ টার দিকে।

Lanavola

আমাদের মাছ কেটে আগেই রেডি করা ছিল, শুধু ভেজে গরম গরম আমাদের সামনে দিলেন। গরম গরম ইলিশ ভাজা, আলু ভর্তা, ডাল আর মাছের মাথা-লেজ ভর্তা দিয়ে তৃপ্তি সহকারে লাঞ্চ করে চলে যাই জোহরের নামাজ পড়তে। মাছ প্রসেসিং সহ মোট বিল দিলাম ৪৭০ টাকা। নামাজ শেষে ত্রিমোহনায় যাই শেষবারের মত কিছু স্মৃতিময় মুহূর্ত কাটাতে। এখন নদীর স্রোত আগের চেয়ে দ্বিগুণ। স্রোতের বিপরীতে যেতে চাওয়া লঞ্চগুলো কিছুতেই সামনে এগুতে পারছিল না। আর বেশিক্ষণ এখানে থাকা যাবে না, কারণ আমরা ৩ টা ৪০ এর লঞ্চ ধরবো। বাসায় নিয়ে যাবো তাই মাছ কিনতে আবার বাজারে ঢুকলাম, কিন্তু যে মাছ আগে ৭০০ টাকা কেজি চেয়েছিল সেটাই এখন ১২০০ টাকা চাচ্ছে। তাই মাছ না কিনেই বেরিয়ে পরলাম।

Lanavola

তবে লঞ্চ ঘাটে যাওয়ার আগে আবার ওয়ান মিনিটের আইস্ক্রিমের স্বাদ নিতে কালীবাড়ি চলে যাই। আমি চাঁদপুর ইলিশের জন্য আসি আর না আসি এই আইস্ক্রিমের জন্য হলেও আবার আসবো ইনশা আল্লাহ। আইস্ক্রিম বিল ১৬০ টাকা এবার আমরা পরিশোধ করি, সাথে ২ টা মিষ্টি ২০ টাকা। আইস্ক্রিম খেতে খেতে এবার সোজা চলে আসি লঞ্চ ঘাটে, পথে শুরু হয় তুমুল বৃষ্টি। অটো ভাড়া ১০০ টাকা দিয়ে ঘাটে নেমে পড়ি। সৈকত ভাইকে বিদায় দিয়ে বৃষ্টি উপেক্ষা করেই উঠে পড়ি সোনার তরী লঞ্চে।

Lanavola

ঠিক ৩ টা ৪০ এ লঞ্চ ছেড়ে দেয়, আমারা লঞ্চের একটা বেঞ্চে বসে সারাদিনের হিসাব মিলিয়ে নিলাম। রাতে ঘুম না হওয়াতে খুব ঝিমুনি লাগছিল। এক কাপ রং চা খেয়ে শরীর চাঙ্গা করার খুব চেষ্টা করলাম, খুব একটা লাভ হল বলে মনে হল না। শেষে রাফসান ভাই ২য় তলার করিডোরে একটা গামছা বিছিয়ে ঘুমিয়ে নিলেন, আমি বসে বসে তার পাহারায় বলতে পারেন। কিন্তু কখন যে আমিও ১০-১৫ মিনিটের মত ঘুমিয়ে নিয়েছি টের পাইনি। আরও এক কাপ রং চায়ে ঘুম কাটানো গেল বটে। আসরের নামাজের পড়ে নিলাম। গোধুলি লগ্নে পশ্চিম আকাশ লাল করে দেয়া সূর্যটা হালকা মেঘের আড়ালে লুকিয়ে আছে, এ এক অপার্থিব দৃশ্য। মাগরিবের নামাজ শেষে ডেকে বসে চানাচুর মাখা খেতে খেতে ভ্রমন নিয়ে আড্ডায় মেতে উঠি। ৭ টা ৩০ এ সদরঘাটে আমাদের নামিয়ে দেয়, লঞ্চ ভাড়া ১১৫ টাকা করে। রিকশা নিয়ে জজ কোর্টের সামনে চলে যাই সেখানে স্টার কাবাবে সামির ভাইয়ের পক্ষ থেকে ডিনার করানো হয় কাচ্চি আর ফালুদা দিয়ে। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি আর হালিম ভাই একসাথে বাড়ির পথে। হালিম ভাই শ্যামলী নেমে গেলে আমি একাই বাকিটুকু রাস্তা শেষ করি। বাসে কয়েকবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম শরীরের ক্লান্তিতে। রাত ১১ টা ৪৪ এ বাসায় আসি আর স্মৃতিময় একটি দিনের সমাপ্তি ঘটে।

Lanavola

মোট খরচঃ

১। বাস ভাড়াঃ ৮০ টাকা

২। সিএনজি ভাড়াঃ ৫০ টাকা (জনপ্রতি)

৩। লঞ্চে সকালের নাস্তাঃ ৬০ টাকা (জনপ্রতি)

৪। যাওয়ার সময় লঞ্চ ভাড়াঃ ১০০ টাকা (জনপ্রতি)

৫। মাছ কেনাঃ ১৪০ টাকা (জনপ্রতি)

৬। সাহাবুদ্দিন স্কুলে যাওয়ার অটো ভাড়াঃ ১০৭ টাকা (জনপ্রতি)

৭। দুপুরের লাঞ্চ খরচঃ ১৫৭ টাকা (জনপ্রতি)

৮। আইসক্রিম খাওয়াঃ ৬০ টাকা (জনপ্রতি) (আইসক্রিম ৪০ টাকা করে ৪ জনের আর মিষ্টি ২০ টাকা)

৯। আসার পথে লঞ্চে চাঃ ৩০ টাকা (ব্যক্তিগতভাবে সবাইকে খাওয়ানো)

১০। আসার পথে লঞ্চ ভাড়াঃ ১১৫ টাকা (জনপ্রতি)

১১। ঘাট পর্যন্ত অটো ভাড়াঃ ৩৩ টাকা (জনপ্রতি)

মোট খরচঃ ১০৫৭ টাকা।

সমাপ্ত

আরো গল্প পেতে এখানে ভিজিট করুন