ভ্রমণ ডায়েরী

Home News Contact About

সাদা ও সবুজ স্বপ্নের সন্ধানে (মানালি-লেহ-কাশ্মীর ভ্রমন) ১ম পর্ব

সাকিব হোসেন

Lanavola

অনেকদিনের ইচ্ছা ছিল লম্বা একটা ট্যুর দিব কিন্তু অফিসের ছুটি ম্যানেজ করতে না পারায় সম্ভব হচ্ছিল না।অবশেষে একটা সুবর্ন সুযোগ পেলাম। আমি ও আমার এক কলিগ (আমরা আগেও একসাথে দার্জিলিং ট্যুর দিয়েছিলাম) মিলে ঠিক করলাম যত দিন লাগে লাগবেই এবার পুরোটা কাভার করেই আসব।মূল প্ল্যান হল মানালী থেকে বাই রোডে লেহ যাব। কিন্তু সময়টা অক্টোবর এর মাঝামাঝি হয়ে যাওয়াতে একটা কনফিউশন হয়ে যায় অই সময় রোড খোলা থাকবে কিনা? শুরু করলাম বিভিন্ন ব্লগ, ফেসবুক গ্রুপ স্টাডি। কেউ বলে সেপ্টেম্বর এর ১৫ তারিখের পর থেকেই বন্ধ, কেউ বলে নভেম্বর পর্যন্ত হয়ত খোলা পাওয়া যাবে। কিন্তু আমরা জানি যে এইবার যদি না যাওয়া হয় তাহলে হয়ত আর কোনদিন সম্ভব হবে না কারন একটানা এতদিন ছুটি ম্যানেজ করা যাবে না। অনেকের কাছ থেকেই তথ্য নিলাম এবং সিদ্ধান্ত নিলাম কপালে যা আছে হবেই, যেখানে রাত সেখানেই কাইত। এদিকে আবার কলিগের ভিসার মেয়াদ ছিল আগের টাই কিন্তু আমার ভিসার মেয়াদ মাত্র শেষ হয়েছে। অতি দ্রুত ভিসা ফর্ম পুরন করলাম সেপ্টেম্বর এর ২৮ তারিখে এবং অক্টোবর এর ৪ তারিখে ই-টোকেন পেয়ে গেলাম। সকল প্রসেস নিজে নিজেই করেছি এবং অক্টোবর এর ১১ তারিখে ভিসা পেয়ে গেলাম। সাথে সাথে গ্রীন লাইন এর সৌহার্দ তে ১৭০০ টাকা করে ১৪ অক্টোবর এর টিকেট করে ফেললাম এবং দুজনে মিলে ৬০০ ডলার কিনে নিলাম। ভ্রমন ট্যাক্স দেওয়ার জন্য সময় পেলাম না বলে ঠিক করলাম বর্ডা্রেই দিব।

Lanavola

ডে ১

১৪ তারিখ যথা সময়ে কমলাপুর কাউন্টার থেকে সকাল ৭ টায় বাসে উঠে পরলাম।বাংলাদেশের BRTC এবং কলকাতার WBTC যৌথ ভাবে সৌহার্দ পরিচালনা করে। একেক দিন একেক টা আসা যাওয়া করে রাই রোটেশন। আমাদের দিন WBTC এর বাস পরেছিল এবং বাস নতুন কন্ডিশন ছিল। ৭ টায় রওনা হয়ে দ্রুত ফেরী ঘাটে পৌঁছে গেলাম এবং কোন রকম সিরিয়াল ছাড়াই ভিআইপি মর্যাদায় ফেরী পার হয়ে গেলাম। দুপুরে একটা মোটামুটি মানের হোটেল এ লাঞ্চ বিরতি দিলে আমরা খাওয়া দাওয়া করে নিলাম ১৮০ টাকা প্যাকেজে চিকেন আইটেম। আবার যাত্রা শুরু এবং ২ টার পরে বেনাপোল বর্ডারে পৌছে গেলাম। বাসের সুপারভাইজার আগে থেকে আমাদের কাছ থেকে ট্যাক্স এর ৬২০ টাকা করে নিয়ে রেখেছিল এবং ডিপারচার ফর্মও পুরন করিয়ে রেখেছিল। আমরা বাস থেকে নেমে ভিতরে যেতে যেতেই আমাদের হাতে ট্যাক্স এর স্লিপ দিয়ে দিল। মনে মনে দুচিন্তা ছিল কি না কি ঝামেলা হয় যেহেতু আগে কখনো বাই রোডে বর্ডার ক্রস করি নাই।অনেকের কাছেই তিক্ত অভিজ্ঞতা শুনেছি।কিন্তু সকল চিন্তা দূর হয়ে গেল যখন দেখলাম মাত্র ৫-৭ মিনিটেই বাংলাদেশ সিমান্তের কাজ কমপ্লিট। আবার বাস এ উঠলাম এবং বাস ইন্ডিয়া সিমান্তে প্রবেশ করল । আমরা নেমে একি ভাবে কাস্টমস এবং ইমিগ্রেশন এ ঢুকলাম। সৌহার্দ বাসের যাত্রি হিসেবে দুই পাশেই আলাদা সুবিধা পাওয়া গেছে। ইন্ডিয়া পাশের কাস্টমস এবং ইমিগ্রেশন ১০-১৫ মিনিটে পার হয়ে গেলাম। কোন ধরনের ঝামেলা বা ঘুষ দেওয়া ছাড়াই। অবাক হয়ে গেলাম আর ভাবলাম এ কিভাবে সম্ভব?

ভাবতে ভাবতে যেই বের হয়ে গেলাম তখনই একটা ধরা খেয়ে গেলাম। একদম গেট এ দেখি গ্রিন লাইন এর লোক দাঁড়ানো এবং তারা জিজ্ঞেস করছে আপনার গ্রিন লাইন এর যাত্রি কিনা এবং পাসপোর্ট দেখতে চেয়ে কিছু বুঝে উঠার আগেই নিয়ে দালাল কে দিয়ে দিল। তারা নাছোড়বান্দা, তাদের কাছ থেকে ডলার ভাঙ্গাতেই হবে। পুরো ৬০০ ডলায় ই ভাঙ্গাতে হবে , রেট দিবে ৬১ রুপী করে কিন্তু তখন কলকাতায় রেট ৬৬ রুপী করে পাওয়া যাচ্ছে। চিল্লা পাল্লা করে অনেক কস্টে ২০০ ডলার ভাঙ্গিয়ে নিয়ে বাস এ উঠলাম। এই জায়গায় সবাই সাবধান, ভুলেও কারও হাতে পাসপোর্ট দিয়েন না। বৃষ্টির কারনে বাস একটু দেরি করে অবশেষে রাত ৭ টার দিকে কলকাতা ইন্টঃ বাস টার্মিনালে পৌছে গেলাম। আগে থেকেই Booking.com এ হোটেল বুকিং দেওয়া ছিল সল্ট লেকে Hotel Emerald Residency তে।খুব ভাল মানের হোটেল মাত্র ১৫০০ রুপী তে। আবাসিক এলাকাতে বাসা বাড়ি দিয়ে হোটেল পরিচালনা করছে, এবং তাদের ব্যাবহার ও খুব ভাল। ফ্রেশ হয়ে ডিনার করার জন্য বের হলাম। কিছুক্ষন হাটাহাটি করে ডিনার সেরে হোটেল এ ব্যাক করলাম।

Lanavola

ডে ২

সকালে হোটেল থেকে কম্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট পেলাম। নাস্তা সেরে হোটেল চেক আউট করে আমাদের ব্যাগ হোটেলের লবি তে জমা দিয়ে চললাম কালকার টিকেট কাটার জন্য ফেয়ারলি প্লেস এ। প্ল্যান হচ্ছে কলকাতা থেকে কালকা গিয়ে টয় ট্রেন এ শিমলা যাব আগে, ওখান থেকে মানালী। গিয়ে দেখি প্রছুর ভীর এবং আমাদের ফর্ম এর সিরিয়াল পড়ল ৩৭ নাম্বার এ। প্রায় ২ ঘন্টা অপেক্ষার পর কাউন্টার এ ডাক পড়ল। কিন্তু হায়, পরের ৩ দিনের ও কালকার টিকেট নাই। কি আর করার, ৩ দিন ত আর বসে থাকা যায় না? সিমলার প্ল্যান বাদ দিয়ে দিল্লি হয়ে মানালি যাওয়ার প্ল্যান করলাম। দিল্লির ওই দিনের দুরন্ত এক্সপ্রেস এর টিকেট পেলাম এবং জার্নি ডেটে টিকেত করার জন্য কিছু ডিস্কাউন্টও পেলাম। ২৭০০ রুপী করে ২ জনের এসি 3A Tier এর টিকেট করে নিলাম। বিকাল ৫ টায় ছেড়ে ১৭ ঘন্টায় (পরেরদিন সকাল ১১ টায়) দিল্লি পৌছাবে।

টিকেট নিয়ে বের হয়ে হাওড়া স্টেশন, হাওড়া ব্রিজ এবং আশে পাশের কিছু লোকাল সাইট ঘুরে বেড়ালাম। তারপর চলে এলাম নিউ মার্কেট এ ডলার ভাঙ্গাতে এবং সিম কিনতে। মাত্র ৫ মাস আগের সিম (দার্জিলিং ট্যুর এর) ছিল আমাদের কাছে, ভেবেছিলাম অইগুলা দিয়েই কাজ চালিয়ে নিব কিন্তু এগুলো ৩ মাসের মধ্যে রিচার্জ না করলে বন্ধ হয়ে যায়। মারকুইস স্ট্রীট এ গিয়ে সিম নিলাম ২০০ রুপি দিয়ে AIRTEL এর এবং খালেক হোটেল এ কালা ভুনা দিয়ে দুপুরের লাঞ্চ।এর পর সল্ট লেকে হোটেলে গিয়ে রেস্ট নিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পরলাম শিয়ালদাহ স্টেশন এর উদ্দেশ্যে। উবার এ চলে এলাম স্টেশন এ। সময় হাতে থাকায় বিগ বাজারে ঢুকে কিছু কেনা কাটা করে নিলাম। অবশেষে কাঙ্ক্ষিত সময়ে চলে আসলো আমাদের দুরন্ত এক্সপ্রেস ট্রেন। আমরা ট্রেনে উঠে নির্দিষ্ট সিটে বসে পরলাম, আমাদের দুজনের সিট ছিল সাইড লোয়ার বার্থ (উইন্ডো) অ্যান্ড মিডল বার্থ। ঠিক ৫ টায় ট্রেন ছেড়ে দিল এবং ছাড়ার পর থেকে শুরু হল খাওয়া দাওয়ার পালা। একটু পর পরই খেতে দেয় এরা এবং খাওয়ার মান ও খুব ভাল। গল্প সল্প করে রাতের ডিনার সেরে ঘুমুতে গেলাম। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ২ টা বালিশ, বেড শীট, গায়ে দেওয়ার কম্বল সব রেডি। পুরো দমে এসি সাথে কম্বল আর ক্লান্তি মিলে সেই লেভেলের ঘুমে চলে গেলাম ।

Lanavola

ডে ৩

খুব ভোরে কলিগের ডাকে ঘুম ভাঙল, তখন আমরা উত্তর প্রদেশের উপর দিয়ে যাচ্ছি। উঠে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে যা দেখলাম সেটা দেখে চক্ষু কলাগাছ হইয়া গেল। সারি সারি লাইন ধরে মানুষ, নারী পুরুষ নির্বিশেষে প্রাকৃতিক কাজকর্ম সারতেছে। এমনও দেখলাম যে, ক্ষেতে ৮-১০ জন নারী পুরুষ গোল করে বসছে তাও আবার খুব অল্প ব্যাবধানে। হাতে একটা পানির বোতল বা এক কৌটা নিয়ে হেটে, সাইকেলে বা বাইকে করে চলে আসছে এই কর্ম সম্পাদন করতে। চিন্তা করা যায়, বাইক পার্ক করে, হাতে স্মার্ট ফোন নিয়ে খোলা জায়গায় এই কাজ করতেছে। উত্তর প্রদেশের পুরোটাই প্রায় সকাল ৭ টা পর্যন্ত এগুলাই দেখলাম চারপাশে। তারপর আস্তে আস্তে ফ্রেশ হতে হতেই সকালের নাস্তা হাজির। ট্রেন সকাল ১১ টায় পৌঁছানোর কথা থাকলেও লেট হতে থাকল। প্রথমে ১ ঘণ্টা, ২ ঘন্টা এভাবে চলতে চলতে ৯ ঘন্টা লেট করল ট্রেন।

এই ট্রেনের নাকি এত লেট কখন হয় নি, এই লেট এর রেকর্ড এর অংশ হতে পেরে গর্বিত লাগতে লাগল। কি আর করার, শুয়ে বসে সময় কাটাতে লাগলাম। যেখানেই ট্রেন থামছিল সেখানেই নেমে ওখানকার স্ট্রীট ফুড কিনে খাচ্ছিলাম। এদিকে দুশ্চিন্তা বাড়তে লাগল যে রাতের মানালির বাস ধরতে পারব কিনা। অনলাইন এ বাসের টিকেট কাটার প্ল্যান থাকলেও সময়ের অনিশ্চয়তায় সাহস হচ্ছিল না। অবশেষে রাত ৮ টায় ট্রেন দিল্লি স্টেশনে এসে থামল। নিজেদের জিনিসপত্র নিয়ে মারলাম দৌড়। এই স্টেশন এতই বড় যে, বের হতেই ১৫-২০ মিনিট লেগে গেল। এদিকে ৯;৩০ এ মানালীর শেষ বাস ছেড়ে যাবে কাশ্মির গেট ISBT থেকে। স্টেশন থেকে বের হলেই মেট্রো স্টেশন, ঢুকেই কাশ্মির গেট এর ২টি টিকেট কেটে উঠে পরলাম এবং ৫ মিনিটের মদ্ধেই গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। ওই টাইমে মেট্রো তে যেই লেভেলের ভীড় ছিল যে দাঁড়ানোই যাচ্ছিল না।তাও ভাল কারন উবারে ১৫০ টাকা আর ১ ঘন্টা সময় লাগবে দেখাচ্ছিল।

Lanavola

মেট্রো থেকে নেমে কাশ্মিরি গেট হতে হাটা দিলাম ISBT এর দিকে কারন সময় আছে আর মাত্র ৩০ মিনিট। ওখানে পৌঁছে মাথা চক্কর মারল। এত্ত সুন্দর তাও আবার বাস টার্মিনাল। ৫-৬ তলা হবে আর বাস উপরে উঠে যাচ্ছে।আমাদের এয়ারপোর্টের চেয়েও সুন্দর মনে হয়।যাই হউক ভিতরে ঢুকে হারিয়ে গেলাম, একদিকে সময় কম তার উপর এত বড় জায়গায় কই যাব, মানালির বাস কোন দিকে ইত্যাদি। টিকেট আদৌ পাব কিনা এই শেষ সময়ে সেটাও জানি না। ঘুরতে ঘুরতে মানালির টিকেট কাউন্টার পেয়ে গেলাম এবং টিকেট চাইতেই বলে শেষ বাস চলে গেছে একটু আগে.. টিকেট না পেয়ে যখন দিশেহারা তখন কাউন্টার থেকে বলল আপ্নারা দৌড় লাগান, সামনে বাস এখন পেতে পারেন এবং বাসের ভিতরেই টিকেট কাটার ব্যাবস্থা আছে। দিলাম ভোঁদৌড় এবং আল্লাহর রহমতে জ্যাম থাকার কারনে বাস পেয়ে গেলাম এবং সিট ও খালি ছিল বেশ কিছু। ভলভো এসি বাসে উঠে পড়লাম আর ১৫০০ রুপি দিতে ২ টি মানালির টিকেট নিলাম।

শুরু হল মানালির পথচলা, চলতে চলতে বড় হাইওয়ে তে চলে আসলো বাস যা খুব সুন্দর ও অনেক প্রসস্থ। কিছুক্ষন চলার পর ই একটা ফাইভ স্টার মানের পাঞ্জাবি ধাবা তে ডিনার ব্রেক দিল। বড় সড় একটা থালি নিলাম আর পেট পুড়ে খেয়ে বাস এ উঠে বসলাম। ঝামেলা হল বাসে কোন কম্বল দেয় না উনারা, একে ত ফুল এসি চলতেছে তার উপর কম্বল নাই। বাধ্য হয়ে ডাবল টি-শার্ট, সোয়েটার পরে দিলাম ঘুম। মধ্য রাতে একটু একটু ঘুম ভাঙ্গছিল, তখন চন্ডিগড় এর উপর দিয়ে যাচ্ছিলাম। এত সুন্দর রাস্তা ,গাছপালা দিয়ে ভরা আর সুন্দর প্ল্যানিং করা যে মনে হচ্ছিল ঘুরে ফিরে একই রাস্তা দিয়ে চলতেছি লোপের মত। রাত বাড়ার সাথে সাথে শীত বাড়তেছিল, মানে আমরা হিমাচল প্রদেশে ঢুকছিলাম। ভোর রাতে এক জায়গাই বাস থামলে, ছোট কাজ করার জন্য নামলাম, সাথে সাথে মনে হল পুরো শরীর বরফ হয়ে গেল। কাজ সেরে দৌড়ে বাসে উঠে পরলাম।

চলবে.........

২য় পর্বের লিংক এখানে