স্বপ্নের লাদাখ ভ্রমণ- ন্যাড়া পাহাড়ের টানে (পর্ব ৮)

সামনে রাস্তার কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছিল তাই গাড়ির গতি আরো কমে গেল। মনে হচ্ছিল অনন্ত সময়ের জন্য ছুটে চলেছি। রাস্তার এমন বেহাল দশার কারণে সন্ধ্যার আগে মানালি পৌঁছাতে পারবো কিনা তাই নিয়ে সন্দেহ করছি এখন। পথে ২.৭ কিলোমিটার লম্বা কুল্লু টানেল এর ভিডিও করতে নিজের সিট ছেড়ে সামনে চলে যাই যাতে ভালভাবে ভিডিও করা যায়। একই টানেল এইবার নিয়ে আমার দ্বিতীয় বার, এর থেকে বড় টানেল আমি দেখিনি। টানেল শেষ করে পিচ ঢালা পথে ছুটে চলেছে আমাদের গাড়ি।

কুল্লু পার হবার পর ২০১৭ সালে যেখান রাফটিং করেছিলাম সেই জায়গাটা চোখে পড়তেই অনেক স্মৃতির কথা চোখে ভেসে উঠলো, সে কথা না হয় অন্য একদিন বলবো। গতবছর বন্যায় অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এই রোডে যার মেরামত এখন চলছে। চঞ্চলা বিয়াস নদীর এই গতি দেখলে মনে হতে পারে এটাই বুঝি এর স্বাভাবিক স্রোত, ভরা বর্ষায় এর দ্বারা কি পরিমান ক্ষতি হতে পারে তা রাস্তার বর্তমান হাল দেখলেই বোঝা যায়। অবশেষে বিকেল ৪ টার দিকে প্রায় ৪ ঘন্টা লেট করে আমাদের নামিয়ে দেওয়া হয় মানালি বাস টার্মিনালে, যা মূল মানালি শহরের নিচে অবস্থিত বিয়াস নদীর তীরে। পাহাড়ি পিচঢালা রাস্তা দিয়ে উপরে উঠছি আর হাঁপিয়ে যাচ্ছি। ১৮ ঘণ্টা টানা বাস জার্নিতে সবাই খুব ক্লান্ত ছিল তাই যত দ্রুত সম্ভব একটা হোটেল নিতে চাচ্ছিলাম। আশেপাশে কোন হোটেল দেখলে সেটাতে খোঁজ নিচ্ছি কোন রুম আছে কিনা। ক্লান্ত শরীরে ৩ টা হোটেল দেখার পর আমার হোটেল খোঁজার সাধ মিটে গেছে।

ছবিঃ ঈদের দিনের সেবাই

দ্রুত হোটেল পাওয়ার আশায় আমি গতবার (২০১৭ সালে) যে হোটেলে ছিলাম সেই হোটেল "নিউ নীলকমল" এ গিয়ে খোঁজ নিলাম, হোটেল থেকে মল রোডে যেতে ২-৩ মিনিট সময় লাগে। সেখানকার ম্যানেজার খান সাহেব কে রুম আছে কিনা জিজ্ঞেস করতেই বলল তিন তলাতে খালি আছে ভাড়া দুই রুমের ৩৬০০ রুপি লাগবে, অথচ এর আগের বার আমরা তিনজন ছিলাম এক রুমে ভাড়া ছিল মাত্র ১২০০ রুপি করে। শারীরিক ক্লান্তি থাকার কারণে আমরা অন্য কোন হোটেল আর দেখতে চাচ্ছিলাম না, তাই পাসপোর্ট দিয়ে হোটেলে চেক ইন করে নিই। এইবার শুধু শর্ত হিসেবে এক রুমে এক্সট্রা মেট্রেস আর বালিশ দিতে হবে। আমরা চারজন এক রুমে আর সোহাগ ভাই এবং প্রীতি আপু আরেক রুমে। চারজন একে একে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। সবাই একসাথে লাঞ্চ করার জন্য বাইরে চলে যাই।

ছবিঃ বিয়াস নদী

লাঞ্চের মেনু ছিল ভাত, ডাল, আলু গোবির তরকারি আর চাটনি। খাচ্ছিলাম আর মনে মনে ভাবছিলাম যে যদি দেশে থাকতাম তাহলে হয়তো পোলাও মাংস খেতে খাওয়া হতো প্রিয়জনদের সাথে। ঈদের দিন সাধারণত আমরা সেমাই খেয়ে মিষ্টিমুখ করি। ডেজার্ট হিসেবে দেশ থেকে আনা সেই সেমাই সবাই তৃপ্তি সহকারে খেয়ে নিলাম। বেশ অবাক হলাম এই ভেবে যে ৩ দিনেও সেমাই এতটুকুও নষ্ট হয়নি।

মানালিতে আজকে আমার দ্বিতীয় ঈদ ভাবতেই কেমন যেন স্মৃতির পাতা ঘেঁটে দেখতে ইচ্ছে হলো। গতবারের পরিচয় হওয়া মানালির বন্ধু পঙ্কজ কে ফোন দিয়েছিলাম আজকে সকালে। সে চাকুরীর সুবাদে একটা ট্রেনিংয়ে এখন মান্ডি আছে তাই দেখা হলো না এবার। যদিও অনেক আগে থেকেই খুব করে কথা দিয়েছিল যে আমাদের সাথে দেখা করবে। গতবার রাফটিং শেষে মানালিতে পৌছাতে রাত হয়ে গিয়েছিল, তখন রুম পাওয়া নিয়ে পঙ্কজ আমাদের সাহায্য করেছিল। যদিও এই একই হোটেল নিয়ে মজার একটা কাহিনী আছে, সেটা অন্য একদিন বলবো।

ছবিঃ মানালি মল এরিয়া

খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই মল রোডে চলে যাই, সেখানে অসংখ্য মানুষের ভীড়। এতো এতো মানুষ কেউ গুজরাটি, কেউ মারাঠি, কেউ বিহারী কেউবা আমাদের মতো বিদেশী। সাদা চামড়ার বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়, এ যেন টুরিস্টদের এক মিলন মেলা। নেট থেকে জেনেছি মাত্র সপ্তাহ খানেক হলো রোথাং পাস খুলেছে তাই এতো বেশি পর্যটকের ভীড়। রোথাং পাস হচ্ছে মানালি-লেহ হাইওয়ের পাঁচটি উঁচু পাসের প্রথমটি, যার উচ্চতা ১৩,০৬০ ফুট। বরফ থাকার কারণে এটি টুরিস্টদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি জায়গা। মানালি-লেহ হাইওয়ে যদি খোলা থাকে তবে রোথাং পাস যাওয়ার পাশাপাশি এই ট্যুরিস্টদের একটা অংশ হয়তো আমাদের মত লাদাখও যাবে।

ছবিঃ হোটেল বারান্দা থেকে