স্বপ্নের লাদাখ ভ্রমণ- ন্যাড়া পাহাড়ের টানে | মোঘল রোড স্পেশাল (পর্ব ১৪)

রাজৌরি পার হয়ে বিকেল চারটার দিকে আবার খাবারের জন্য বিরতি দেওয়া হয় তাউই নদীর পাশেই একটা হোটেলে। হোটেলের বাইরে হাত মুখ ধোয়ার সময় ৭-৮ বছরের কিউট একটা মেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে "আপনার বিয়ে হয়েছে"? আমি দুষ্টামি করে জবাবে বললাম "যদি আমার বিয়ে না হয় তবে আপনি আমাকে বিয়ে করবেন?" একথা শুনে সে ভীষণ লজ্জায় পায়, একবারে লজ্জায়-লাল বলেতে যা বুঝায়। লাঞ্চ হিসেবে ভাত, কাশ্মিরি জনপ্রিয় রিসতা আর সাথে খাসি ভুনা। মনে হচ্ছে কতদিন পর যেন মাংসের স্বাদ নিচ্ছি। রিসতা আসলেই জিভে জল আনার মত একটা ডিশ, যা একবার-দুইবার খেলে তৃপ্তি মিটবে না। খাবার খাচ্ছি এমন সময় খেয়াল করি আমার হাতে সুন্দর করে মেহেদি দেয়া আছে, ঈদ উপলক্ষে এখানে আসার আগে বউ অনেক যত্ন করে হাতে লাগিয়ে দিয়েছে। সেই কারণেই হয়তো মেয়েটির আমার বিয়ের ব্যাপারে কৌতূহল দেখিয়েছিল।খাবার শেষে সেই মেয়েকে আবারও জিজ্ঞাসা করলাম "বিয়ে করবেন আমাকে?" এবার আগের থেকেও বেশি লজ্জা পেল মনে হয়, তাই এবারো লাজুক হাসি দিয়ে দূরে চলে গেল।

খাবার শেষে আবার যাত্রা শুরু করি, এবার বেশ কিছুক্ষণের জন্য সঙ্গী হিসেবে "তাউই নদী"। রাজৌরির পর থেকে শুরু হয়েছে মোঘল রোড, আসলে মোঘল রোড রাজৌরি আর পুঞ্ছ জেলাকে শ্রিনগরের সাথে যুক্ত করেছে। হঠাৎ মোস্তাক ভাই বললেন, "একটা চাকায় লিক আছে, যেহেতু সামনে আর চাকা ঠিক করার কোন উপায় নেই তাই এখান থেকেই ঠিক করতে হবে। এখন ঠিক না করলে সামনে বিপদে পড়তে হতে পারে"। এমন নীরব, নির্জন আর কোলাহলমুক্ত জায়গায় ছোট একটা গ্যারেজ মাত্র, একটু দূরে পাহাড়ের উপরে একটা মাত্র বাড়ি আছে। চাকার লিকেজ ঠিক করার এই সময়টাতে আমরা একটু সামনে হাটতে থাকি।

১০০ গজ সামনেই ছোট একটা ঝর্ণা ঠিক রাস্তার পাশেই। ঝর্নার ঝুমঝুম আওয়াজ চারিদিকের নীরবতা ভেঙে দিচ্ছিলো। মুহূর্তটা লিখে বা বলে বোঝানো যাবে না, শুধু অনুভব করা যাবে। আমরা যেন শুধু এই ঝর্ণা দেখতেই এতো দূরে এসেছি, এই মুহূর্তটা আমার কাছে এই ট্যুরের সব থেকে আনন্দের ছিল। শুনেছিলাম কোন এক কবি কাশ্মীকে দুনিয়ার জান্নাত বলেছেন। আর সেটাই আমার মনে পড়ে গেল এমন অপার্থিব দৃশ্য দেখে। ঝর্নার ঠিক উল্টো পাশে (মানে রাস্তার অপর পাশে) পাহাড়ের খাড়াই গিয়ে ঠেকেছে নিচে নাম না জানা কোন এক সরু নদীর বাঁকে। সময়টাকে স্মরণীয় করে রাখতে ঝর্নার হিমশীতল ঠান্ডা পানিতে ওজু করে আসরের নামাজ আদায় করে নিলাম। লিকেজ সাড়া শেষে আবার সামনে যাত্রা শুরু করি, এবার পাহাড়ে হেয়ার ক্লিপ বাঁকের পরিমাণ বেড়ে গেল, যেন অনন্ত সময়ের জন্য উপরে উঠছে তো উঠছেই।

শেষ বিকেলে সূর্যটা আরও বেশি আলোকিত হয়ে পশ্চিম আকাশে ঝুকে পড়েছে। আর দূর পাহাড়ের চূড়ায় সাদা বরফগুলো আরো বেশি চকচকে হয়ে উঠেছিল, আবার পাহাড়ি বাঁক নেয়ার সাথে সাথে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছিল। পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে আলো ছায়ার লুকোচুরি খেলা আমাকে পাহাড় প্রেমী করে তুলেছে, এই লুকোচুরি আরও বেশি আকর্ষন করে। উপরে উঠছি আর সবুজ আস্তে আস্তে কমে আসছিল। এই রোডে একসময় মোঘল সম্রাটরা তাদের ঘোড়া ছুটিয়েছেন আর এখন আমরাও একই রাস্তায় প্রকৃতির নিংড়ানো সবটুকু সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে যাচ্ছি ভাবতেই অসাধারন লাগছিল। সামনে আর্মি চেকপোস্টে গাড়ি চেক হচ্ছে, তাই ৩০-৩৫ টা গাড়ির একটা জ্যামে পড়ে যাই। গাড়ি থেকে নেমে আমি যখন সিরিয়ালে আইডি হিসেবে আমার পাসপোর্ট দেখালাম একজন আর্মি বললেন আপনাদের আলাদা চেক করা হবে।

আমাদের সবাইকে আলাদা করে উপরে নিয়ে গেলেন। সময় কম লাগবে ভেবে তিনজন শীতের জামা গাড়িতে রেখে এসেছে। তীব্র ঠাণ্ডা বাতাসে আমাদের ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমান করে মোটামুটি ৫০ মিনিট আমাদের জেরা করেন। আমরা কোথায় কোথায় যাবো, কিভাবে এসেছি, কবে যাবো, কিভাবে যাবো, কোথায় থাকবো, কোন বর্ডার দিয়ে বা ফ্লাইটে দেশে ফিরবো, কোন ফ্লাইটে কাশ্মীর থেকে বের হবো ইত্যাদি নোট করছিলেন। তাছাড়া আমাদের পাসপোর্ট-ভিসার ছবি, কাশ্মীর থেকে কলকাতার বিমান টিকেটের ছবি, আমাদের ছবি সবই তুলে রাখলেন। বিদেশী হিসেবে তারা আমাদেরকে চেয়ারে বসিয়ে উপযুক্ত সম্মান দিয়েই সবকিছু জিজ্ঞাসা করেছেন। তবে সাদা চামড়ার বিদেশী হলে হয়তো কিছু অযাচিত প্রশ্ন আমাদের করা হতো না।

চেকপোস্টের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আবার উপরের দিকে উঠছি তো উঠছিই এখানে কোন গাছপালা বলতে কিছুই নেই। অক্সিজেনের মাত্রা কমতে শুরু করেছে, যেহেতু আমরা মানালির উচ্চতা থেকে মানিয়ে এসেছি তাই উচ্চতা জনিত "একিউট মাউন্টেন সিকনেস" হওয়ার সম্ভবনা কম। ১০-১৫ মিনিটের মধ্যেই চারিদিকটা কেমন যেন অন্ধকারে ছেয়ে যেতে লাগলো। মোঘল রোডের সবথেকে উঁচু স্থান "পীর পাঞ্জাল পাস বা পীর কা গলি" যার উচ্চটা ১১৪৩৩ ফিট, সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাতের ঘন অন্ধকার। সন্ধা ০৮:২৪ বাজে তখন, যদি চেকপোস্ট আর একটু কম সময় লাগতো তাহলে হয়তো সন্ধ্যার কিছুটা আগেই চলে আসতাম এখানে। পূর্ণিমা রাত হওয়াতে একদম কাছের পাহাড়ে বরফগুলো জ্বল জ্বল করছিল, এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। দিন হলে হয়তো আরও সুন্দর লাগতো, আরও অনেক দুরের দৃশ্যও দু'চোখ মেলে দেখা যেত। বিকেল থেকে যে বরফের পাহাড়গুলো আমাদের সাথে লুকোচুরি খেলেছে, ভাবতেই পারিনি সেই জায়গা হয়েই আমরা শ্রীনগর যাব।

অন্ধকার আর শরীরে ক্লান্তি ভর করাতে কখন ঘুমের রাজ্যে ঢুকে পড়েছি বুঝতেই পারিনি। সোপেইন আসার পর এক কাপ গরম গরম চায়ে শরীর চাঙ্গা হয়ে উঠে। আমরা যখন পুলওয়ামা জেলার উপর দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন নাম শুনেই ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম।কারন কিছুদিন আগে পুলয়ামাতে বোমা হামলায় অনেক সেনাবাহিনীর সৈন্য মারা। আমাদের ড্রাইভার মোস্তাক ভাইও আমাদের ভয় দেখাচ্ছিলেন যে, এই অংশে অনেক সময় পাথর ছুড়ে মারে গাড়িতে। অবশেষে রাত ১১:২০ এ খায়েম চকের একটা গেস্ট হাউজে আমরা চেকইন করি। ফ্রেশ হওয়া আর খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমাতে ঘুমাতে প্রায় রাত ১২:২০। হোটেলের নরম বিছানায় গায়ে কম্বল জড়িয়ে শুয়ে পড়ি। একটানা ২৯ ঘন্টা জার্নি ধকল কাটাতে গভীর ঘুমে ঢলে পড়ি।