স্বপ্নের লাদাখ ভ্রমণ- ন্যাড়া পাহাড়ের টানে | মোঘল রোড স্পেশাল (পর্ব ১৩)

জম্মুতে নেমে সবাই ফ্রেশ হয়ে নিলাম। আমাদের বাসেই সফর করেছে সাদা চামড়ার একটা বিদেশী দল, হয়তো বা ইউরোপের হবে। সেই দলের একজন এসে আমার কাছে জানতে চাইলো আমরা শ্রীনগর যাবো কি না? আমি হ্যাঁ বলাতে আমরা কিভাবে যাবো তা জানতে চাইলো, আমি তখন তাকে বললাম আমরা আগে থেকে গাড়ি ঠিক করে রেখেছিলাম সেটা দিয়েই এখন শ্রীনগর যাবো। ভাড়া কত লাগবে সেটা জানতে চাইলে আমার জানা না থাকাতে তাকে কোন সাহায্য করতে পারলাম না। কাশ্মিরী সিম না থাকতে একজন স্থানীয় লোকের ফোন দিয়ে আমাদের রিজার্ভ করা গাড়ির ড্রাইভার মোস্তাক ভাইকে কল করে তার অবস্থান জেনে নিলাম। ফোন দিয়ে সাহায্য করা লোকটাকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিলাম কিভাবে আমরা মোস্তাক ভাই পর্যন্ত পৌঁছাব। একটা লোকাল বাসে করে নাম ভুলে যাওয়া একটা জায়গায় নামি, সেখান থেকে হেঁটে আরও ৭-৮ মিনিট পর আমরা মোস্তাক ভাইয়ের দেখা পাই।

মোস্তাক ভাই সুদর্শন এক কাশ্মীরি যুবক, তার সাথে পরিচয়পর্ব সেরে আমরা ১১ টার দিকে মোঘল রোড ধরে শ্রীনগরের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। আমরা ইচ্ছা করলে ৬৬ কিলোমিটার যাত্রা কমিয়ে প্রায় ৩ ঘন্টা কম সময়ে জম্মু-শ্রীনগর হাইওয়ে দিয়ে শ্রীনগর পৌঁছাতে পারতাম। কিন্তু সুজন ভাইয়ের পূর্ব অভিজ্ঞতা অনুযায়ী এই রোডের জার্নি আরও বেশি ভাল লাগবে তাই মোঘল রোডে দিয়ে যাওয়া। মোঘলদের শাসন আমলের আগে এই রোডের আসল নাম ছিল নামাক রোড (লবনের রাস্তা), কারণ এই রোড দিয়ে পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে কাশ্মীরে লবন রফতানি করা হতো। এই রোডকে মোঘল রোড বলা হয় কারণ মোঘল সম্রাট আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান, অওরঙ্গজেব তাদের কাফেলা নিয়ে ভূস্বর্গ কাশ্মীরে যেতেন।

আমাদের ট্যুরে জম্মুর নাম কোনভাবেই ছিল না, চলে যেহেতু এসেছি তাই ঐতিহাসিক এই রোডের স্বাদ নিতে সমস্যা কোথায়? এখন চলছি ইট পাথরের ব্যাস্ত জম্মু শহর দিয়ে। কারোরই এখনো নাস্তা করা হয়নি, নাস্তা করার প্ল্যান করা হল জম্মু শহর থেকে বের হয়ে সবুজের মাঝে কোন এক নির্জন, নিরিবিলি পাহাড়ি এলাকায়। রাস্তার পাশের টিউবওয়েল থেকে নেওয়া ঠাণ্ডা পানি আর কলকাতা থেকে কেনা সেই বিস্কিট খেয়ে আমরা ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করি।

পাহাড় প্রেমী হিসেবে, সুযোগ পেলে প্রিয়তমা কে দেখার কোন সুযোগ মিস করি না, হোক সে দেশে বা বিদেশে, ছোট বা বড়। কিন্তু বাড়িতে বউয়ের মন খারাপ, এই সাত দিন আমার সাথে কথা বলতে পারবে না বলে। মোস্তাক ভাই নেট ব্যবহার করে কি না জানতে চাইলে তিনি হ্যাঁ বলেন। তার মোবাইল থেকে হট্স্পট কানেকশন নিয়ে বউকে একটা সারপ্রাইজ দেওয়া গেল বটে। শহুরে কোলাহল পেরিয়ে কিছুটা নির্জন গ্রামের মধ্য দিয়ে চলতে শুরু করলাম ঘণ্টা খানেক পরেই। শরীরে টানা ভ্রমনের ক্লান্তি তো আছেই তবুও এমন সুন্দর সবুজ প্রকৃতির কোন কিছুই যেন মিস না হয়ে যায় সেইজন্য চোখ বন্ধ হতে চাইলেও খোলা রাখার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। স্বল্প দূরত্বের ছোট পাহাড়ের সাড়িগুলোর পরেই পাকিস্তান সীমান্ত আর এই রাস্তা তার সৌন্দর্যের মহিমা আস্তে আস্তে প্রকাশ করছিল।

রাস্তা্র দুইপাশের গাছপালা যেন সবুজের কার্পেট বিছিয়ে রেখেছে। আর পাহাড়গুলো আমাদের খুব কাছাকাছি হাত দিয়ে ছোঁয়া যাবে এমন দূরত্বে সহযাত্রী হিসেবে ছুটে চলছিল। প্রায় দেড় ঘন্টা পর যতদূর মনে পরে "ফাগাল" নামের ছোট একটা বাজারে নাস্তার বিরতি দেয়া হয়। নাস্তার থেকে এখন লাঞ্চ বললেই মনে হয় ভাল হয়। জায়গাটা বেশ নিরিবিলি আর মনোরম, ছোট ছোট পাহাড় ঘেরা আর চারিদিকে সবুজের সমারোহ। একটি মাত্র হোটেল আছে এখানে, ফ্রেশ হয়ে রাজমা চাওয়াল নিলাম খাওয়ার জন্য। রাজমা হচ্ছে শিমের বিচি (Kidney Bean) আর টমেটোর তৈরি একটা তরকারি যা ভাতের সাথে দেয় বলে এই খাবারকে রাজমা চাওয়াল বলে। খুবই সুস্বাদু এই খাবার পুষ্টিগুণে ভরা। তৃপ্তি সহকারে খেয়ে একটা কোকে চুমুক দিতে দিতে আবার যাত্রা শুরু করি।

সারিসারি দেবদারু, আর পাইন গাছের বন যেন সবুজের এক বিশাল ক্যানভাস যেখানে চাইলেই মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুখ দুঃখ সবকিছুই আঁকা যায়। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে মাঝেমধ্যেই সমতলে ছুটে চলছিলাম, তখন যৌবন ফিরে পাওয়া কোন সুন্দরী নদী বয়ে চলছিল আল্পনা একে আমাদের সাথে সাথে। পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয় বরফে ঢাকা বহু দূরের কোন পর্বতের শৃঙ্গ, আবার নিমিষেই মিলিয়ে যায় কোন এক পাহাড়ি বাঁকে।