স্বপ্নের লাদাখ ভ্রমণ- ন্যাড়া পাহাড়ের টানে (পর্ব ১১)

হোটেলে ফিরে গোসল সেরে নিলাম সবাই। তারপর হোটেল থেকে চেক আউট করে হোটেলের লবিতে ব্যাগ রেখে নাস্তা করতে একটা বাঙালি হোটেলে যাই, যেখানে গত বারের মানালি ট্যুরে কয়েকবার খাওয়া হয়েছিল। হোটেলটা ছিল আমাদের থাকার হোটেলের ঠিক সামনে হিমালয় নিনমাপা তিব্বতিয়ান মনেস্ট্রির নিচ তলায়। সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম তারা তাদের লোকেশন চেঞ্জ করেছে। তাদের দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী সেই হোটেল খুঁজে বের করে লুচি আলুর দম দিয়ে নাস্তা করলাম সাথে চা। নাস্তা শেষে হাদিম্বা টেম্পল ঘুরেতে বেরিয়ে পড়ি।

মল রোডে কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে, কিছুকিছু দোকান মাত্র খুলছে। মল রোডের শেষে বাম পাশের পথটা ধরে হাঁটতে শুরু করি। সামান্য ঢালু সরু রাস্তায় মোটর সাইকেল আর প্রাইভেট কারের লম্বা জ্যাম লেগে আছে। সেই জ্যামের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। ২০১৭ তে গাড়ি ভাড়া করে হাদিম্বা টেম্পল সহ অন্যান্য কয়েকটা স্পট ঘুরেছিলাম। হাতে যেহেতু সময় আছে তাই মোটামুটি ১.৭ কিলোমিটার রাস্তা হেঁটেই যাবো আর আসবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। রাস্তাটা সামান্য ঢালু হলেও এই জ্যাম আর মানুষের হালকা ভিড় ঠেলে যেতে ভালোই কষ্ট হচ্ছিল। বারবার হাপিয়ে পড়ছিলাম, মাঝেমাঝে একটু বিরতি নিলাম। মন্দিরে যাওয়ার রাস্তার শেষ অংশটুকু একটা মাঝারি সাইজের টিলাতে উঠে হয়, তাই কষ্টও নেহাত কম হয় নি। প্রায় ৩৫ মিনিট হাঁটার পর হাদিম্বা টেম্পল গিয়ে পৌঁছাই। গত ট্যুরে গাড়িতে আসায় মনেই হয়নি এতটা দূরে আর এতটা কষ্ট হবে।

চারিদিকে বিশাল আকারের দেবদারু গাছের বন, মাঝখানে এই মন্দিরটি অবস্থিত। সবুজের চাদরে মোড়ানো প্রকৃতির মাঝে পাথরের উপর বসে একটু বিশ্রাম নিতেই এতদূর হাটার কষ্ট নিমিষেই ভুলে গিয়েছি। এই মন্দিরটির নাম হাদিম্বা দেবীর নাম অনুসারে ১৫৫৩ সালে মহারাজা বাহাদুর সিং নির্মাণ করেন। হাদিম্বা দেবী ছিলেন ভিমার স্ত্রী যিনি পঞ্চ পাণ্ডবদের একজন ছিলেন। হাদিম্বা দেবী এই জায়গায় বসে ধ্যান করতেন। নবরাত্রিতে সারা ভারতের হিন্দুরা দেবী দুর্গার পূজা করেন কিন্তু মানালীর হিন্দুরা হাদিম্বা দেবীর পূজা করেন। তাতেই বুঝা যায় এই মন্দির এখানে কতটা গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে।

মন্দিরের বাইরে কয়েকশত মানুষ অপেক্ষা করছেন পূজা করার জন্য। আমরা চারিপাশটা ঘুরে দেখে নিজেদের মত করে সময় কাটাই। ঘন বনের মধ্যে আলোছায়ার খেলা, মৃদু ঠান্ডা হাওয়া আর পাখির কলকাকলি মনকে প্রশান্ত করে দেয়। এখানে মানালির ট্র্যাডিশনাল ড্রেস ভাড়ায় পাওয়া যায়, যা পড়ে ছবি তোলার জন্য অনেকই ভাড়ায় নিচ্ছে সময়টাকে স্মরণীয় করে রাখতে। আসলে ইন্ডিয়ার বেশিরভাগ জায়গায় তারা এমনভাবে তাদের সংস্কৃতি তুলে ধরে বাইরের পর্যটকদের কাছে। তাতে তাদের দুইটা ফায়দা হচ্ছে, এক- তারা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির পাশাপাশি সারা দেশে যে সংস্কৃতির বৈচিত্র্য আছে তা সবার কাছে ছড়িয়ে দিচ্ছে। দুই- তারা এর মাধ্যমে একটা ভাল পরিমাণ টাকা নিজেদের পকেটে ঢুকাচ্ছে। এভাবে কখন যে দেড় ঘণ্টার মত সময় পার করে ফেলেছি তার টেরই পাইনি। এবার ফেরার পালা, ফেরার সময় খুব সুন্দর হেয়ারকাট করা একটা ইয়াক দেখে হেসেই লটোপুটি খাই। পর্যটকরা অর্থের বিনিময়ে সেই ইয়াকের উপর উঠে ছবিও তুলছেন। আসলে তারা পর্যটনটাকে মানুষের কাছে কিভাবে আকর্ষণীয় করে তোলা যায় তার কোন চেষ্টাই বাদ রাখে নি।

এবার রাস্তায় হাটতে জ্যাম ছাড়া আর কোন সমস্যা হচ্ছে না, কারণ এইবার শুধু আস্তে আস্তে নিচের দিকে নামছি। এইবার ২০ মিনিটেই আমরা মল এইরিয়াতে পৌঁছে যাই। এখানের স্থানীয় মহিলারা ছোট ছোট ওয়ান টাইম চায়ের কাপে করে চেরী বিক্রি করছে ২০ রুপি করে। ২ কাপ আর আরও কিছু বোনাস হিসেবে চেয়ে নিয়ে মিষ্টি সেই ফল সবাই ভাগ করে প্রথমবারের স্বাদ নিলাম। ৩ টা বেজে গেছে, এবার লাঞ্চ করার পালা। আমাদের থাকার হোটেলের পাশের মার্কেটে একটা হোটেল থেকে চিকেন বিরিয়ানি (হালাল ছিল) দিয়ে লাঞ্চ করে কিছুক্ষণ রেস্ট নিলাম। পরে আবারও কিছু ফল কিনে ভাগ করে খেলাম।