স্বপ্নের লাদাখ ভ্রমণ- ন্যাড়া পাহাড়ের টানে (পর্ব ১০)

ফোনের এলার্মের শব্দে রাত ৩ টা ৩০ এ আমাদের ঘুম ভাঙে। ওয়াশরুমের পানি এতটাই ঠান্ডা যে জরুরী কাজকর্ম সারবো নাকি সারবো না সে নিয়ে দোটানায় পড়ে গেছি। রাত ৩:৪৫ এ গাড়ির ড্রাইভারকে ফোন দেই সে আসছে কিনা তা জানতে। সে বলল আপনারা রাস্তায় বেরিয়ে আসুন আমি আপনাদের পিক করে নিবো। চারটা বাজার ৫ মিনিট আগেই আমরা মেইন রোডে চলে আসি। ড্রাইভারকে আবার ফোন দিয়ে আমাদের অবস্থান জানানোর ৫ মিনিটের মধ্যেই আমাদের সামনে চলে আসেন। ভোর চারটার মধ্যে না বের হলে পাহাড়ী রাস্তায় কিছু কিছু জায়গাতে খুব বেশি জ্যামে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে যার কারণে কপাল খারাপ থাকলে ফিরে আসতে বিকেল হয়ে যেতে পারে।

ছবিঃ অনেকেই ফেরত চলে আসছে

গাড়ি ছুটে চলেছে অন্ধকার ভেদ করে ৫১ কিলোমিটার দূরে ৩৯৮০ মিটার অর্থাৎ ১৩,০৫৮ ফুট উঁচু রোথাং পাসের উদ্দেশ্যে। এইবার নিয়ে আমার দ্বিতীয়বার সেখানে যাওয়া হবে। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর ড্রাইভার একটা জায়গায় বিরতি দিলেন বরফ এ যাওয়ার উপযোগী জামা কাপড়, জুতা ইত্যাদি ভাড়া দেয় এমন একটা দোকানে। সবগুলো বেশ পুরনো জামা কাপড়, তার মধ্য থেকে যতটুকু সম্ভব ভালো জামা, জুতা বেছে নিলাম ২৫০ রুপির বিনিময়ে। কেউ ইচ্ছা করলে নাও নিতে পারেন, তবে বরফে শুয়ে একটু আয়েশ করতে চাইলে এই জামা নেওয়া যেতেই পারে। এত উঁচুতে বরফ দেখতে যাওয়া নিয়ে সবার মনেই এক্সাইটমেন্ট কাজ করছিল। এই বিরতিতে অনেক গাড়ি আমাদের আগে চলে যাচ্ছিল আর আমার মনে টেনশন হচ্ছিল এই ভেবে যে, না জানি কত গাড়ির পিছনে সিরিয়াল দিতে হয়।

ছবিঃ গোলাবা বর্ডার

গোলাবা বর্ডার গিয়ে প্রায় ৪০ মিনিটের মত সিরিয়াল দিয়ে গাড়িতে বসে থাকতে হয়। কারণ গোলাবা বর্ডার সকাল ছয়টার সময় খোলে। ঠিক সকাল ৬ টা বাজতেই গাড়ি আস্তে আস্তে সামনে দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। প্রত্যেকটা গাড়ির পারমিশন পেপার চেক করে তবেই সামনে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হচ্ছিল। ইতিমধ্যে চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার ভেঙে নতুন দিনের জানান দিচ্ছিল। আমাদের সামনে বেশি গাড়ি ছিল না, তাই খুব বেশি সময় লাগলো না গোলাবা বর্ডার পার হতে।

ছবিঃ প্রায় পৌঁছে গেছি

আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তায় এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। সদ্য ঘুম থেকে উঠা কোন রমণীর মত দূর পাহাড়ের চূড়াগুলো সাদা বরফের চাদর জড়িয়ে স্বমহিমায় তার সৌন্দর্যের দিকে আমাদের আহ্বান জানাচ্ছে। রাস্তার হেয়ার ক্লিপ বাঁকগুলো এই রোডের অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ দিচ্ছিল। চারিপাশে ছড়িয়ে থাকা মেঘগুলো পাহাড়ের গায়ে ঘোমটা দেয়া কোনো রমণীর মত করে সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। যেতে যেতে দূরে দেখা সেই পাহাড়ের সাদা বরফের চূড়াগুলো আমাদের নিকট থেকে নিকটতর হচ্ছিল। মাঝে মাঝে রাস্তার অবস্থা খুবই শোচনীয়। উপরে উঠতে উঠতে এক সময় আমরা যাচ্ছিলাম পথের দুই পাশে বরফের দেয়ালের মাঝ দিয়ে। সবাই একসাথে তখন "জাব উই মিট" মুভির "এ ইশক হায়ে....." গানের কলি গেয়ে উঠি। সেই গানে এমন কিছুই দেখেছিলাম যা আমাদের চোখে এখন বাস্তব উপস্থিত। ভেড়ার পাল মাঝে মাঝেই আমাদের রাস্তা আটকে দিচ্ছিল।

ছবিঃ ঘুমানোর প্রস্তুতি

চোখ ধাঁধানো বরফের শুভ্রতা দেখতে দেখতে সকাল সাড়ে সাতটার দিকে আমরা পৌঁছে যাই রোথাং পাস। গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথে হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রা আর ঠান্ডা বাতাসে বেশিক্ষণ টিকে থাকতে যে পারবো না তা ভালভাবেই বুঝতে পারলাম। উপরের দিকে উঠে বরফে শুয়ে বসে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কাটিয়ে দিলাম। আগেরবার জুনের শেষ সপ্তাহে এতটা ফ্রেশ বরফ পাইনি, কিন্তু এবার এমন সাদা বরফ যে সানগ্লাস ছাড়া বেশিক্ষণ তাকাতেও পারছিলাম না। একটু উচুঁতে উঠে ঢালু জায়গাতে নিজেকে ভাসিয়ে দিলাম বরফে পিচ্ছিল খেয়ে নিচে নামতে। তখন ফিরে গিয়েছিলাম শৈশবের স্মৃতিতে, যখন পুকুর পাড়ে এমনভাবে নিজেকে ছেড়ে দিতাম পুকুরের পানিতে পড়ে যেতে।

ছবিঃ বরফে রেস্ট নিচ্ছি

এভাবে যখন আর একটু উচু থেকে আর একবার চেষ্টা করছিলাম তখন হাঁটুতে পুরোনো জায়গায় ব্যাথা পাই। মনে হচ্ছিল আর হাঁটতে পারব না, আমার ট্যুর বুঝি এখানেই শেষ। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম। চুপচাপ কাউকে কিছু না জানিয়ে ৫ মিনিট বসে রেস্ট নিলাম, তাতে আস্তে আস্তে হাঁটার অবস্থা তৈরি হলো। ভেবেছিলাম ঘন্টাখানেক থাকবো এখানে, কিন্তু আধা ঘন্টাও থাকা সম্ভব হবে না এমন ঠান্ডায়, হাত পা জমে যাওয়ার মত অবস্থা। তাই ৪০ মিনিটের মধ্যেই আবার গাড়িতে ফিরে আসি। এখন যত দ্রুত পারি রাস্তায় জ্যাম এড়িয়ে মানালিতে ফিরে যাওয়া হবে আমাদের আসল উদ্দেশ্য। মনে অনেক কষ্ট নিয়ে ফিরতে হচ্ছিল, কারণ এই রোড যদি লাদাখ পর্যন্ত খোলা থাকতো তাহলে আর মানালি ফিরে আসতে হতো না বরং আমরা সামনে এগিয়ে যেতাম আমাদের স্বপ্ন পূরণ করতে।

ছবিঃ রোথাং পাসে

ইচ্ছা ছিল রাস্তায় কোন হোটেল বা ধাবাতে বিরতি দিয়ে নাস্তা করে নিবো, কিন্তু সেই একই ভয় "জ্যাম" এর কারণে আর রাস্তায় নাস্তা করা হয়নি। যদি কোন কারণে জ্যামে আটকে যাই তাহলে বিকেলে জম্মু যাওয়ার বাস মিস করতেও পারি। মাঝে রাস্তায় জিপ লাইনিং করতে চেয়েছিল কেউ কেউ কিন্তু পরে এত কম দূরত্ব কিন্তু টাকার পরিমাণ বেশি তাই সেটা বাদ দেওয়া হল। সামান্য সময়ের জন্য কিন্তু মনের মাঝে সারাজীবন গেঁথে থাকবে এমন কিছু স্মৃতিময় সময় নিয়ে সকাল দশটার মধ্যে মানালিতে ফিরে আসি। মাঝে ভাড়া নেওয়া জামা জুতাগুলো ফেরত দিয়ে এসেছিলাম।

ছবিঃ ফেরার সময়

ছবিঃ বরফের দেয়াল

ছবিঃ হেয়ার ক্লিপ বাঁক