স্বপ্নের লাদাখ ভ্রমণ- ন্যাড়া পাহাড়ের টানে - পর্ব ০৯(নতুন করে স্বপ্ন দেখা)

দোকানিরা রাস্তার পাশে নানান ধরনের স্ট্রীট ফুডের পসরা নিয়ে বসে আছেন, সেগুলো রাতে টেস্ট করবো। দিনের আলো থাকতে থাকতে মল রোডের সাথে লাগোয়া ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে লাদাখ যাওয়ার ব্যাপারে গাড়ির ড্রাইভারদের সাথে কথা বলতে গিয়ে জানতে পারলাম ১০ জুনের আগে মানালি-লেহ রোড খোলার সম্ভবনা নাই। রোথাং পাস খুললেও বার-লা-চালা পাস এখনো খুলে দেওয়ার মত পরিস্থিতি হয় নি, সেখানে এখনো কিছু বরফ রাস্তায় রয়ে গেছে। সবারই মন খারাপ হয়ে যায়, আমাদের খারাপ ধারণা এখন বাস্তবে পরিণত হয়েছে।

ছবিঃ ৬ ফ্লেভারের সফটি আইসক্রিম

যদি লেহ-মানালি হাইওয়ে আরো দুইদিন পরেও খুলত তাহলে আমরা মানালিতে থেকে যেতাম এই দুই দিন, বোনাস হিসেবে মানিকরনে একটা ডে ট্যুর হয়ে যেত। কিন্তু ১০ তারিখ পর্যন্ত যেহেতু খুলবে না তাই সবারই মন ভেঙ্গে যায়। এত দূরে এসে লাদাখ যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে না। মানালি লেহ রোডের ছবির মত নানা রঙের পাহাড়ের উপরে শুভ্র বরফগুলো ছুয়ে দেখা হবে না, না হবে জিসপাতে তীব্র শীতে তাবুতে থাকার স্বপ্ন পূরণ। এসব কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না, এ যেন এক দুঃস্বপ্ন। মানালি উপভোগ করার পরিবর্তে ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্ন কিভাবে বাস্তবে পরিণত করা যায় সে চিন্তা করতে থাকি।

ছবিঃ এই সেই কানটুপি

যেভাবেই হোক আমাদের লাদাখ যেতেই হবে তাই আমরা ঠাণ্ডা মাথায় বিকল্প খুজতে থাকি। বিকল্প হিসেবে আমাদের লাদাখ যাওয়ার নতুন রোড মানালি-জম্মু-শ্রীনগর-লেহ ফাইনাল করি। মানালি-লেহ রোডের অপরূপ সৌন্দর্য মিস করবো, সে কষ্ট থেকেই যাবে যতদিন না এই রোডে লাদাখ যেতে পারবো। আমাদের প্রথম কাজ মানালি থেকে জম্মু যাওয়ার জন্য বাস টিকেট করা। টিকেট কাটতে গেলাম ট্যাক্সি স্ট্যান্ড লাগোয়া HRTC বাস কাউন্টারে। সেখানে একটা মাত্র নন এসি বাস আছে কিন্তু ৬ টা সিট হবে না, তাই আগামীকাল বিকেল সাড়ে ৫ টার তানিস্ক এর এসি বাসের টিকেট করে নিলাম ৬০০ রুপিতে। ইতিমধ্যে সুজন ভাই তার পূর্ব পরিচিত কাশ্মিরী ড্রাইভারের সাথে আমাদের বিকল্প প্ল্যান অনুযায়ী জম্মু-শ্রীনগর-লেহ-শ্রীনগর-এয়ারপোর্ট ড্রপ এর জন্য কথা পাকা করে ফেলেন। তাকে ভাড়া বাবদ ৩৫,০০০ রুপিতে দিতে হবে। সে আগামী পরশু সকালে আমাদের জম্মু থেকে পিক করবেন। সমস্যা সমাধান হয়েছে এখন চিন্তা মুক্ত।

ছবিঃ কেশর মিল্ক ১

পরের দিন শুধু রোথাং পাস যাওয়ার জন্য গাড়ি ঠিক করবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। সেই অনুযায়ী কয়েকজন ড্রাইভার এর সাথে কথা বললাম ভাড়া নিয়ে। বেশিরভাগ ড্রাইভার তাদের গাড়ী অনুযায়ী ভাড়া ১০ থেকে ১২ হাজার রুপি চাইল। শুধুমাত্র একজন ড্রাইভার নয় হাজারে রাজি হলেন। আমরা তার নাম্বার রেখে দিয়ে আরো একটু যাচাই করে দেখতে চাইলাম। শেষ পর্যন্ত যখন আর কাউকে কমে পেলাম না তখন সেই ড্রাইভারকে ফোন করে আমাদের পিক কোথা থেকে করতে হবে তা বলে ট্রিপ কনফার্ম করলাম।

ছবিঃ কেশর মিল্ক

সন্ধার পর আলোক সজ্জায় চারিপাশটা রঙ্গিন হয়ে উঠে, আগের থেকেও বেশি জমকালো, বেশি জমজমাট। অন্ধকার নামার পাশাপাশি শীতের মাত্রা বাড়তে থাকে। শীতের জামা পড়ে থাকা সত্ত্বেও কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসে শরীর জমে যাওয়ার মত অবস্থা। দেশ থেকে কান টুপি নিয়ে আসা হয়নি, এই শীতে কান টুপির গুরুত্ব আমি এখন হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছি। দেরী না করে একটা কান টুপি কিনে নিলাম, তবুও এমন একটা নিলাম যা দেখে আমি সবসময় অন্যদের মনে মনে ফটকা টাইপের কিছু বলতাম। তবে তখন সেই টুপি আমাকে ঠাণ্ডায় প্রশান্তি এনে দিয়েছিল, আর এখন নিজের কাছে অনেক পছন্দের।

ছবিঃ গোলাপ জামুন

রাতে এই হাড় কাপানো শীতে ৬ ফ্লেভারের সফটি আইস্ক্রিম খাওয়া, মানালির স্পেশাল চাট, রাস্তার পাশে গরম গরম গোলাপ জামুন, কেশর মিল্ক, আর সুজন ভাইয়ের সংগ্রহ করা কয়েক ধরনের স্থানীয় ফল সময়টাকে স্মৃতির পাতায় স্মরণীয় করে রাখে। একটা পানি পুরী ওয়ালার পাশে অনেক ভিড় দেখে টেস্ট করার লোভ সামলাতে পারলাম না। চার জনের হাতে ওয়ান টাইম বাটি দিয়ে পানিপুরিওালা দিতে শুরু করলো, আর আমরাও খুব মজা নিয়ে খেতে শুরু থাকি। খাওয়া শেষে বিল জিজ্ঞেস করলে আমাদের ২৫ টা বলেন। আমাদের হিসেবে ১৬-১৭ টার বেশি কিছুতেই হচ্ছে না। শেষে ২৫ টার বিল দিয়েই চলে আসি আর নিজেরাও সতর্ক হই বেহিসাবি কিছুই ভাল না। রাত ৯ টার দিকে রুটি আর ডাল দিয়ে ডিনার করি।

ছবিঃ মল এরিয়া

ডিনার শেষে টানা জার্নির ক্লান্তি দূর করতে হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় নাইট শিফটে হোটেল ম্যানেজার চেঞ্জ হওয়াতে নতুন ম্যানেজার এক্সট্রা ম্যাট্রেস দিলেও কোনোভাবেই এক্সট্রা বালিশ দিতে রাজি হচ্ছিল না। এ নিয়ে তার সাথে আমার একচোট ঝগড়া হয়ে গেল। শেষমেষ পুলিশের কাছে নালিশ করবো বলাতে বালিশ দেন। নতুন কোন স্বপ্ন দেখতে সবাই ১০ টার মধ্যেই শুয়ে পড়ি কারণ ভোর ৪ টায় আমাদের রোথাং পাস যাওয়ার জন্য বের হতে হবে।

ছবিঃ মল রোডে জুসবার

ছবিঃ মানালির চাট

ছবিঃ রাতের ডিনার

ছবিঃ রাতের মল এরিয়া