সাদা ও সবুজ স্বপ্নের সন্ধানে (মানালি-লেহ-কাশ্মীর ভ্রমন) ২য় পর্ব

ডে ৪

সাত সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখ খুলে যা দেখলাম তাতে শুধু চোখ এ জুড়ালো না, মন প্রান, কলিজা, ফেপড়া সব জুড়িয়ে গেল। একপাশে পাহাড়ি রাস্তা, শুধু পাহাড় আর অন্য পাশে বহমান নদী আর আঁকাবাঁকা পথ। আঁকাবাঁকা পথ সাথে বিয়াস নদীর স্রোতের শব্দে আর প্রাকৃতিক সুন্দর্যে মন ভরে যায়। মানালি পর্যন্ত এই বিয়াস নদী ধরেই এগুতে থাকবেন আর বিমোহিত হতে থাকবেন। মানালি যাওয়ার পথে বাসের ডানপাশে বসার চেস্টা করবেন বেস্ট এক্সপেরিয়েন্স এর জন্য। কিছুক্ষন পর কুল্লু শহরে এসে পৌঁছলাম। কুল্লুও এত সুন্দর মনে হয় ২-১ দিন শুধু এখানেই থাকি। এদিকের বিখ্যাত রাফটিং, প্যারাসেইলিং মূলত কুল্লুর টাই বেশি নামকরা।

এখানে ঘন্টা খানেক এর একটা বিরতি পেলাম কারন পরবর্তী বাস আসলে সেটাতে আমাদের ট্রান্সফার করে দিবে। নেমে প্রচন্ড শীতের মধ্যে আশেপাশের কিছু এরিয়া ঘুরলাম, এখানকার ISBT থেকে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। একটু ছোট হলেও বেশ সুন্দর ও পরিপাটি টার্মিনাল। আমাদের দেশের টার্মিনাল বলতে যা বুঝি তার চেয়ে হাজার গুন ভাল। লোকাল মার্কেটের শাল দেখলাম, কুল্লুর শাল অনেক বিখ্যাত। একটা কাপল এর সাথে পরিচয় হল যারা বাংলাদেশি এবং আমাদের সাথেই একই বাসে এসেছে। উনাদের সাথে নাম্বার বিনিময় করে কুল্লু এক্সপ্লোর করে আবার নতুন বাসে উঠে পরলাম।

সেই একই রাস্তা ধরে মনোরম পরিবেশ উপভোগ করতে করতে ১০ টার দিকে পৌঁছে গেলাম মানালী। বলে রাখা ভাল বাসে বসেই মানালী তে ২ দিনের হোটেল বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম booking.com থেকে। আমরা চিরাচরিত হোটেল এ না উঠে একটু unconventional হোটেল এ উঠতে চেয়েছিলাম। তাই নতুন অভিজ্ঞতা নেওার জন্য YOLO Backpackers Hostel এ বুকিং করেছিলাম। এটা মুলুত দেশি বিদেশি solo ট্রাভেলারদের জন্য হোস্টেল যারা লং টাইম স্টে করে এবং কম খরচে। পুরাতন বাস স্ট্যান্ড এ বিয়াস নদীর একটা শাখার পাশেই হোস্টেল টা।দেখতে বেশ চকচকা এবং সর্বক্ষন বিয়াসের পানির শ্রোতের গর্জন শোনা যায়। খুব সুন্দর এবং বেশিরভাগ বিদেশি বিশেষ করে ইসরাইলি পর্যটকে ভরা। খাওয়া প্লাস গানের আসর এর জায়গা টা খুব এ স্পেশাল ছিল এবং সামনেই আপেল গাছ ছিল। রেট ও বেশ কম, দুই রাতের জন্য মাত্র ১০০০ রুপি ডাবল বেড প্লাস রান্না করে খাওয়ার মত সকল ব্যাবস্থা। নতুন বাস স্ট্যান্ড থেকে নেমে একটা অটো নিয়ে ৭০ রুপি ভাড়ায় হোটেল এ চলে এলাম। এসে আগে নাস্তা খেয়ে নিলাম আলু পরোটা উইথ এগ ১০০ রুপি পার প্লেট এ। তারপর গরম পানিতে গোসল দিয়ে লম্বা একটা ঘুম দিলাম ।

ঘুম থেকে উঠে হোটেলের সৌজন্যে আধা বেলার জন্য একটা সপ্নের Royal Enfield Bullet 500 cc ভাড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। নিজের দেশের ড্রাইভিং লাইসেন্সে আর কিছু টাকা এডভান্স করলেই ১০০০ রুপি পার ডে বাইক ভাড়া পাওা যায়। তেল নিজের ভরতে হবে। আশেপাশের স্পট গুলা সব ঘুরলাম। পাহাড়ি রাস্তায় বাইক ড্রাইভ এর যেই মজা সেটা বলে বুঝানো যাবে না। বাট আমার কলিগ বাইক চালাতে পারে না বলে দূরে যাওয়ার সাহস হয় নি। ইচ্ছা ছিল ৫-৭ দিনের জন্য বাইক ভাড়া নিয়ে লাদাখ ট্যুর দেওয়ার বাট সাহসে কুলায় নাই। দুজনেই চালাতে জানলে আল্লাহর নামে বেরিয়ে পরতাম।

মাইলের পর মাইল কোন জনমানব নাই। সব ঘুরে সন্ধ্যায় মল রোডে এলাম স্ট্রীট ফুড ক্ষেতে চলে এলাম। নতুন কোথাও গেলে সবার আগে সেখানকার স্ট্রীট ফুড টেস্ট করতেই হবে। চেনা অচেনা চোখের সামনে যেই খাবার এ পড়ছে সেটাই খাইছি। খেয়ে দেয়ে সন্ধ্যার মল রোড উপভোগ করে হোটেল এ ফিরে এলাম। এসে রাতের খাবার খেতে গিয়ে দেখি বিশাল আড্ডা। মোট কথা দেশ বিদেশের সবাই মিলে গানের আসর বসছে। খাওয়া দাওয়া প্লাস আড্ডা দিয়ে আজকের দিন শেষ করলাম।

ডে ৫

হোটেলের সাহায্যে আজকের দিনের জন্য গাড়ী ঠিক করে রেখেছিলাম। আর হ্যা বলতে ভুলে গেছি, ওই যে দেশি কাপল টার সাথে পরিচয় হল তারা মানে অনিক ভাই ফোন করে একসাথে লোকাল সাইট সিয়িং এর অফার করল। তাতে টেক্সি ভাড়াও শেয়ার হবে প্লাস একসাথে গ্রুপে ঘুরা যাবে। আমরা যেই গাড়ী টা ভাড়া করেছিলাম সেইটা ৩০০০ রুপি তে সারাদিন ঘুরাবে যেই কয়টা পয়েন্ট আছে। সকালে যথারীতি গাড়ী এসে হাজির হোটেলের সামনে। গাড়ী নিয়ে রওনা হলাম নিউ বাস স্ট্যান্ড এর দিকে কারন অনিক ভাই ওখানে উঠেছিল।

এখান থেকে শুরু হল আমাদের যাত্রা রোহতাং পাসের দিকে।শুরুতেই পোশাক ভাড়া নিতে হল কমপ্লিট ২০০ রুপি করে পার পারসন। ওখান থেকে পাহাড়ি পথ ধরে উপরে উঠতে থাকলাম আর শীত বাড়তে থাকল সাথে হাল্কা পাতলা নিশ্বাস এর সমস্যাও দেখা দিতে পারে। আকা বাকা পথ আর অক্সিজেন কম হওয়ার কারনে মাথা ঘুরা শুরু হচ্ছিল তীব্র। তবে সব কিছুর পরেও আশে পাশের সৌন্দর্যে মন ভরে যেতে থাকল।

দুনিয়ার কোন ক্যামেরায় সেই সুন্দর বন্দি করতে পারবে না। পাহাড়ের মাথায় বরফ চিকচিক করছিল, আর আঁকাবাঁকা সুন্দর লুপের রাস্তা গুলা মন ভরিয়ে দিচ্ছিল। এর মাঝে একটা রেস্টুরেন্ট এ সকালের নাস্তা করে নিলাম এবং রওনা হয়ে কিছুক্ষন পরে পৌঁছে গেলাম কাঙ্ক্ষিত রোহতাং পাস এ। গাড়ী থেকে নামার সাথে সাথে বাতাসের তীব্র ধাক্কা অনুভুত করলাম সাথে অক্সিজেন এর অভাব। কিছুক্ষন রেস্ট নিয়ে চা খেয়ে স্বাভাবিক হয়ে রোহতাং এর সোউন্দর্য দেখে অভিভুত হয়ে পড়লাম। উপরে নীল আকাশ, পাহাড়ের মাথায় বরফ, নিচে জমাট বরফ হয়ে থাকা পানি সব কিছুই সুন্দর। যতদুর চোখ যায় শুধু সুন্দর আর সুন্দর। ইচ্ছামতন সুন্দর দেখে, সুন্দর খেয়ে, সুন্দরে গড়াগড়ি করে রোহতাং পাস থেকে ব্যাক করা শুরু করলাম।

ওখান থেকে আসার পথে আরেকটা পয়েন্ট আছে মানে একটা ঝর্না যেইটা অনেক উপর থেকে খাড়া ভাবে পরে মূল রাস্তার নিচ দিয়ে প্রাবাহিত হচ্ছে। দেখতেও বেশ সুন্দর এবং ঝরনার পানির পরিমান ও অনেক বেশি ছিল। ছবি তুলার জন্য ঝরনার অনেক উপরে উঠে গিয়েছিলাম এবং ফটোশুট করে রওনা হলাম পরবর্তী গন্তব্ব্যের দিকে সোলাং ভ্যালি।

একই পথে ফিরে এসে চলে আসলাম সোলাং ভ্যালি। সোলাং ভ্যালি টা আমার আহামরি কিছু লাগে নি। তবে এখান থেকে প্যারাসেইলিং করা যাই, ক্যাবল কার এ করে অনেক উপরে উঠা যায়। তারপর একে একে হাদিম্বা টেম্পল, মানু টেম্পল ওল্ড মানালি সবে কিছু ঘুরে দেখলাম। মাঝে দুপুরের লাঞ্চ করে নিয়েছিলাম একটা রেস্টুরেন্ট থেকে আলু পরোটা দিয়ে। সব ঘুরা শেষে নতুন বাস স্ট্যান্ড এ নেমে ভাড়া দিয়ে গাড়ী বিদায় দিয়ে হোটেলে ফিরে আসলাম।

আসার আগেই প্রায় সব কয়টা টুরিস্ট কোম্পানি তে ঘুরলাম লেহ যাওয়ার জন্য কিন্তু কেউ এ রাজি হয় না। ৫-৭ দিন আগে থেকেই নাকি অফিসিয়ালি সকল টুরিস্ট বাস, গাড়ী, টেম্পো ট্রাভেলার সব বন্ধ হয়ে গেছে। মন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যেতে লাগল কারন আমার পুরো ট্যুর এর আসল টার্গেট হল মালানি-লেহ বাই রোডে ভ্রমন করা। এখন এতদুর এসে কিভাবে ঘুরে যাই? দুই একজন রাজি হচ্ছিল বাট অনেক বেশি টাকা চাচ্ছিল যেটা দিয়ে যাওয়া পসিবল না।

এমন সময় পিছনের স্টাডি থেকে একটা জিনিস মনে পরে গেল, জম্মু কাশ্মির এর কিছু মানুষ পার্সোনাল গাড়ী নিয়ে বিভিন্ন কাজে মানালি আসে। ওই গাড়ি ধরতে পারলে যাওয়া পসিবল। সাথে সাথে J & K স্ট্যান্ড এ J & K নাম্বার প্লেট এর গাড়ী খুজতে গেলাম এবং যেয়ে দেখি কিছু গাড়ী পার্ক করাও আছে। অতি উত্তেজনায় বুক ধুক ধুক করতেছিল এমন সময় একজন কে পেয়ে গেলাম লবজং নামে যে কিনা আজ সকালে এসেছিল লেহ থেকে পার্সোনাল কাজে এবং সন্ধ্যায় লেহ ব্যাক করবে। মনে হল আকাশের চাঁদ পেলাম, চাতক পাখির বৃষ্টি পেলাম। সে ১৫০০ রুপি করে চাইল পার পারসন কিন্তু আজকেই যেতে হবে। অইদিকে আমাদের প্ল্যান ছিল মানালি তে আরেকদিন থাকার, কিন্তু লেহ যাওয়ার কাছে এইটা কিছুই না। তাই চোখ বন্ধ করে কনফার্ম করে দিলাম এবং দৌড় লাগিয়ে হোটেল এ গেলাম সব কিছু গোছ গাছ করে আরলি চেক আউট করে নিলাম।

লাদাখের ওই গাড়ী আমাদের হোটেলে নিয়ে এসেছিল আর আমাদের নিয়ে আবার নিউ বাস স্ট্যান্ড এ চলে আসলো। এখন অপেক্ষা লেহ এর উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার। অতি উত্তেজনায় সময় কাটছিল না, এমনকি গাড়ী তেল নিচ্ছে পাম্প থেকে সেই সময়টুকুও কাটছিল না। লেহ যাব, ওখান থেকে শ্রীনগর যাব, সত্যি বলতে পুরো ট্যুর এর আমার টার্গেট এ ছিল এই রুট টুকু ট্রাভেল করা। অপেক্ষা চলছে......। এখান থেকে শুরু হবে লেহ যাত্রা যা পরের পর্বে থাকবে।

ছবি