স্বপ্নের লাদাখ ভ্রমণ- ন্যাড়া পাহাড়ের টানে(পর্ব ১৬)

জিরো পয়েন্ট থেকে বেরিয়ে বরফের প্রাচীর আর এবড়ো থেবড়ো রাস্তায় ধীরে ধীরে চলতে থাকি। ভালো রাস্তা পাওয়ার সাথে গাড়ির গতিও বাড়তে থাকে। জিরো পয়েন্টের পর আমাদের গাড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে বেশিরভাগ সময় বয়ে চলেছে খরস্রোতা দ্রাস নদী। আঁকাবাঁকা নদীর সাথে বন্ধুত্ব গড়ে আমরাও প্রকৃতির পরিবর্তন উপভোগ করতে থাকি। দুপুরের খাবারের জন্য দ্রাসে বিরতি দেওয়া হয়। সেখানে গরম গরম রুটি, ডাল আর সবজি দিয়ে লাঞ্চ সেরে নিলাম। খাবার শেষে আবার চলতে শুরু করি। আমরা যেহেতু একদিনেই লাদাখ পৌঁছাবো তাই কোথাও সময় নষ্ট করতে চাচ্ছিলাম না। কিছুদূর পর কার্গিল ওয়ার মেমোরিয়াল দেখতে নামি, কোন এন্ট্রি ফি নেই তবে বিদেশীদের পাসপোর্ট এন্ট্রি করে ভিতরে ঢুকতে হয়। আমরা গেটে পাসপোর্ট আর্মিদের কাছে এন্ট্রি করতে দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ি। ১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেই যুদ্ধে ভারত এবং পাকিস্তানের অনেক সৈন্য নিহত হয়। সেই যুদ্ধের শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে এই সৌধ তৈরি করা হয়েছে। এই খোলা জায়গায় হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা বাতাসে এমনিতেই বেশিক্ষণ থাকতে পারতাম না, সাথে কিছুক্ষণ পরেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু হওয়াতে সেই ঠাণ্ডা দ্বিগুণ হয়ে যায়। তাই ১০ মিনিটের মধ্যেই গেট থেকে পাসপোর্ট নিয়ে গাড়িতে ফিরে আসি। আবার স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশে চলতে শুরু করি।

কার্গিল ওয়ার মেমোরিয়াল

পাকিস্তান সীমান্ত খুব বেশি কাছে হওয়ায় একটা গা ছমছমে অবস্থা কাজ করছিল, কখন আবার তাদের মধ্যে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠে কে জানে। কারণ দুই দেশের সীমান্তে কোথাও না কোথাও মাঝেমধ্যেই আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ হয়ে থাকে। যত সামনের দিকে যাচ্ছি পাহাড় গুলো ততই ন্যাড়া হয়ে যাচ্ছে, সবুজের দেখা নেই বললেই চলে। আমি যেন কোন ধাঁধার মধ্যে আটকে আছি, এইতো আমার স্বপ্নের সেই ন্যাড়া পাহাড় যা দেখার জন্য হাজার মাইল পেরিয়ে এখানে এসেছি। মরুভূমির কথা বললে আমাদের চোখে সাধারণত এক ধরনের ছবি ভেসে ওঠে। কিন্তু এই রোডের যাত্রা আপনাকে অন্য এক ধরনের মরুভূমির সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে, তা হলো পাহাড়ি মরুভূমি/হিমালয়ের মরুভূমি। সবুজ পাহাড় ছাড়াও যে অন্য অনেক বাহারী রঙের পাহাড় হতে পরে তা দেখতে হলে আপনাকে একবার হলেও এই রোডে ভ্রমণ করতে হবে। খয়েরী, বাদামী, ধুসর, কালো, আর ভাষায় প্রকাশ না করতে পারা শত রঙের পাহাড়। একেক পাহাড় একেক রঙের, যেন প্রিয়তমা আপনার জন্য একেক সময় একেক ভাবে সেজে সারপ্রাইজ দেয়। এখানে নীল আকাশ ছুঁয়েছে দূর পাহাড়ের শুভ্র বরফ চূড়ায়। হাজার বছর ধরে পাহাড়ের গায়ে হিমশীতল বাতাসের আলিঙ্গনে পাহাড় যে কত ধরনের রূপের পসরা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করানো যাবে না। এ যেন এক বাস্তব ক্যানভাস, যেখানে আপনার মনের সবগুলো রং দিয়ে রাঙ্গানো। সব মিলিয়ে যেন সুন্দরী কোন অস্পরা শুধু আপনার জন্যই সেজে বসে আছে হাজার বছর ধরে।

ইন্ডিয়ান দ্রাস আর পাকিস্তানি শিংগো নদী মিলনস্থল

মাঝে দ্রাস নদীর সাথে পাকিস্তান থেকে আসা শিংগো নদীর মিলনে আরো যৌবন পাওয়া দ্রাস নদীর অবিরাম ছুটে চলে। আবার কার্গিলের ঠিক আগে দ্রাস নদী, সুরু নদী আর পাকিস্তান থেকে আসা শিংগো নদী এক হয়ে যেন ঐক্যের আহ্বান করে। শরীরে ক্লান্তি আর চোখে ঘুম থাকলেও ছবির মত সুন্দর এই রাস্তার কোন অংশই বাদ দিতে চাই নি। কার্গিলের কিছু আগে পুলিশ চেকপোস্টে এন্ট্রি করে সামনে যেতে থাকি। কার্গিলে গাড়ির চাকা ঠিক করার জন্য কিছু সময়ের বিরতি দেয়া হয়, এই ফাঁকে একটু ঘুমিয়ে নিলাম। ফিরে আসার সময় কার্গিলে এক মজার ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলাম, সেটা পরের জন্য তুলে রাখলাম।

কার্গিল শহর

যত সামনে আগাচ্ছিলাম পাহাড় যেন তার নতুন নতুন রুপ নিয়ে সামেন হাজির হয়। এখানে পাহাড়ের বাঁকেবাঁকে সৌন্দর্য পরিবর্তন হয়। বিচিত্র এই রোডে হাড় কাঁপানো শীতে যেখানে আমরা গাড়ির জানালা খুলতে ভয় পাচ্ছি সেখানে কিছু বাচ্চা সহ একটা পরিবার ছোট ট্রাকের খোলা অংশে বসে দিব্যি তাদের হাসিমাখা মুখে আমাদের দেখে হাত নাড়ছিল। মোস্তাক ভাই গাড়িতে হিন্দি আর পাঞ্জাবী গান চালিয়ে রেখেছিলেন। ছাত্রবেলায় যেসব গান শুনে বড় হয়েছি সেই গানগুলো বাজছিল আর সেই তালেতালে মোস্তাক ভাইও তার গাড়ি চালানোতে মুন্সিয়ানা দেখাচ্ছিলেন। বিকেলে চা নাস্তার বিরতি দেওয়া হয় ওয়াডু নামের একটা ছোট্ট গ্রামের বাজারে। সেখানেই প্রথম আমি নামকিন (লবন) চায়ের স্বাদ পাই, যা কিনা কাশ্মীরের জনপ্রিয় পানীয়। পাশেই একেবারে শুকিয়ে যাওয়া একটি নদী, একফোঁটাও পানি নেই তবুও সে একসময় এখান দিয়ে বয়ে চলতো তার চিহ্ন রেখে গেছে। শীতের সময় এই মানুষগুলো সারা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, আর চরম প্রতিকূলতায় টিকে থাকে। এটাই পাহাড় এর বিশেষত্ব। এই রাস্তায় টানা যাত্রায় আপনি ক্লান্ত হবেন না, ক্লান্ত হবেন চোখের সামনে একের পর এক চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য দেখতে দেখতে।

লেহ শ্রীনগর হাইওয়ে

যখন মন চেয়েছে যেখানে সেখানে গাড়ি থামিয়ে প্রকৃতিকে কাছ থেকে দেখার কোন সুযোগ হাতছাড়া করি নি। শেষ বিকেলে গোধূলি বেলায় যখন সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়ে, পাহাড়ে আলো ছায়ার খেলা এক নৈসর্গিক দৃশ্যের অবতারণা করে। পাহারগুলো আরও বেশি আলোকিত হয়ে সোনালি রঙ ধারণ করেছে, দূর পাহাড়ের চূড়ায় বরফগুলো আরও বেশি চিকচিক করছে। আস্তে আস্তে সাড়া দিনের ক্লান্তি যেন ভর করেছে চারিপাশে, তবুও নতুন রুপ নিয়ে হাজির হতে এতটুকুও দ্বিধাবোধ নেই। এই পাহাড় গুলো বসন্তের সৌন্দর্যে হয়তো কখনোই সাড়া দিতে পারেনা, তবুও তারা প্রকৃতির মাঝে সৌন্দর্য বিলিয়ে দিতে এতটুকুও কার্পণ্য করে না। ছুয়ে দেখার দূরত্বে কিছু কিছু পাহাড় এমন যেন হাত বুলালেই সব মিশে একাকার হয়ে যাবে। আপনি হয়তো ভাবছেন আমি লেখার জন্য এমন উপমা ব্যবহার করেছি, কিন্তু না সত্যিই আপনি যদি কখনো এই রোডে ভ্রমন করেন তাহলে বুঝবেন আমার প্রতিটা ভাবনাই বাস্তব।

আহা সৌন্দর্য

লেহ শ্রীনগর হাইওয়ে

হাসি অমলিন

হারিয়ে যাবো

শেষ বিকেল

নাম না জানা জায়গা লেহ শ্রীনগর হাইওয়ে

হাত বুলালে নিমিষেই মিশে যাবে

সন্ধ্যার আগে একটু আয়েশ