স্বপ্নের লাদাখ ভ্রমণ- ন্যাড়া পাহাড়ের টানে(পর্ব ১৫)

সব কিছু যদি ঠিক থাকে তাহলে আজ লাদাখ যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। ২৯ ঘণ্টার টানা জার্নির ধকল পুরোপুরি না কাটতেই সকাল ৬ টায় ঘুম থেকে উঠে গোসল করে লাদাখের উদ্দেশে রওনা দেই আনুমানিক ৭ টার দিকে। রাতে যখন এই হোম স্টে তে এসে উঠেছি তখন জানার সুযোগ হয়নি বা ইচ্ছা হয়নি যে রুম ভাড়া কত করে ঠিক করেছেন সুজন ভাই। হোটেল থেকে চেক আউট করার সময় তিন রুমের জন্য বিল দিলেন মাত্র পনেরশো রুপি। আমি কিছুটা অবাক হলাম এই ভেবে যে, এত বড় রুম আবার সুযোগ-সুবিধা ও নেহাত কম নয় কিন্তু ভাড়া এত কম? আমাদের গাড়ি চলতে থাকে শহরের ভিতর দিয়ে। গাড়ি থেকেই আমাদের ড্রাইভার মোস্তাক ভাই ইউনিভার্সিটি অফ কাশ্মীর, হযরত বাল দরগাহ দেখান। হযরত বাল দরগাহ তে আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) চুল মোবারক রাখা আছে, ইচ্ছে থাকলেও সেখানে নামা হয়নি কারণ আজ অনেক লম্বা সফর।

সিন্ড নদীর তীরে

ওয়েউল ব্রিজের পাশে সিন্ড ভিউ পাঞ্জাবি ধাবাতে নাস্তার বিরতি দেওয়া হয়, এটা গণ্ডারবাল জেলায়। ধাবাটার নামের সাথে প্রকৃতির পুরোপুরি মিল পেলাম। একদম সিন্ড (সিন্ধু নদী না এটা) নদীর তীরে অবস্থিত, কাছাকাছি দূরত্বে কিছু পাহাড়। এখন মাঝারি গতিতে বয়ে চলেছে নদীটি। এক কথায় নাস্তা করার জন্যে পারফেক্ট একটা জায়গা। ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় আলু পরোটা দিয়ে নাস্তা করে সেভেন আপে চুমুক দিতে দিতে আবার চলতে শুরু করি। রাস্তার সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের সাথে বয়ে চলেছে আঁকাবাঁকা সিন্ড নদী। কোথাও কোথাও নদীর উপর বরফের পাতলা ব্রিজ তৈরি হয়েছে।

সবুজ কাশ্মীর

সবুজের গালিচা বিছানো সোনমার্গ এসে মোস্তাক ভাই প্রস্তাব দেন এখানে কিছু সময় কাটাতে, কিন্তু যেহেতু এখান দিয়েই আমরা লাদাখ থেকে ফিরবো তাই ফিরতি পথে এখানে লম্বা সময় দিব বলে আর নামলাম না। তবে গাড়ি থেকেই যা দেখালাম তাতেই মন ভরে গেছে। আশেপাশের পাহারগুলোতে ঘন সবুজের সাথে মাথায় সাদা বরফের মুকুট, মনে হবে প্রত্যেকটা পাহাড় এখানকার একেকটা রাজা। এখন আমাদের প্রথম উদ্দেশ্য জঝিলা পাস কোন প্রকার যানজটে না পড়ে তারাতারি পার হওয়া। বালতাল (Baltal) ভ্যালী আসতেই পাহাড়ে উঠার খাড়াইয়ের পরিমাণ বেড়ে গেল, কারণ আমরা এখন জঝিলা পাসে উঠতে চলেছি। বালতাল ভ্যালী সম্বন্ধে একটু বলি, আপনারা অনেকেই হয়তো অমরনাথ ইয়াত্রার (যাত্রা) কথা শুনেছেন। অমরনাথ যাত্রায় যাওয়ার ২ টা রাস্তার মধ্যে একটা এখান থেকে শুরু হয়, আরেকটা পেহেলগ্রাম দিয়ে। এখান থেকে অমরনাথ মন্দির ১৪ কিমি হেটে যেতে হয়।

গাড়ী থেকে সোনমার্গ

জঝিলা পাসে উঠতে রাস্তার হেয়ার ক্লিপ বাঁকের (সুক্ষ) পরিমাণ বেড়ে যায়, সাথে কমতে থাকে সবুজের পরিমাণ। সরু রাস্তার মাটিগুলো খুবই ভঙ্গুর প্রকৃতির। কিছু জায়গায় একসাথে ২টা গাড়ি একে অপরকে সাইড দেওয়ারও জায়গা নেই এতটা সরু রাস্তা। ইতিমধ্যে আমরা সাপের মত আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তার ৫-৬ তলা উপরে আছি, আমাদের উপরে আরও একধাপ রাস্তা আছে। উচ্চতাজনিত সমস্যা থাকলে নিচে না তাকানোই ভাল, মনে ভয় ধরিয়ে দিবে। উপরে উপরে যতই সাহস দেখাই না কেন গাড়ি কোন কারণে নিচে পড়ে গেল শরীরের কোন কিছুই আর আস্ত পাওয়া যাবে না সে ভয়ে ঠিকই শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠছে। মাঝেমাঝেই বিপরীত দিক থেকে আসা কোন গাড়িকে সাইড দিতে গিয়ে দাড়িয়ে পড়ছি কিছু সময়ের জন্য। আশেপাশের আকাশ ছোঁয়া পাহাড়গুলো দেখে তাদের নিঃসঙ্গতা অনুভব করছি। নিঃসঙ্গই বা কেন বলবো না পাহাড়গুলোতে হিম শীতল বরফ ছাড়া কোন সবুজের নাম গন্ধ নেই, যেখানে পাখিরা এসে গান গেয়ে তাদের এই একাকীত্ব দূর করবে। এই সেই আমার কল্পনার ন্যাড়া পাহাড়ের শুরু। সামনে প্রকৃতি নিশ্চয়ই আমাকে অবাক করে দেওয়ার মত অনেক কিছুর পসরা নিয়ে বসে আছে। ১১,৫৭০ ফুট উচ্চতার জঝিলা পাস পার হতে হতে বেলা ১১ঃ০০ বেজে যায়।

জঝিলা পাস

প্রকৃতি তার নিজ হাত দিয়ে রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে চলা এক সরু নদীর উপর বরফের ব্রিজ বানিয়ে রেখেছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে চারিপাশটাই বদলে গেছে। সবুজ দিয়ে শুরু তারপরে রুক্ষতা আর এখন সাদা বরফের চাদর। জিরো পয়েন্টে বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে বরফে ছেয়ে আছে, আর আমরাও সেখানে বিরতি দিতে ভুল করিনি। এখানে বরফের বিভিন্ন এক্টিভিটি করার ব্যবস্থা আছে যেমন স্নোমোবাইল রাইড, আইস স্কীং, আইস স্লেডিং ইত্যাদি। গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথেই ওইখানে যারা এগুলো অপারেট করে তারা আমাদের ঘিরে ধরেছিল এগুলো করার জন্য। বছরের এই সময়ে এতটা ফ্রেশ বরফ আশা করিনি। পরে জানতে পারলাম গতকাল এখানে স্নোফল হয়েছিল। এই প্রথম কেন জানি বরফের মধ্যেও চৈত্রের উত্তাপ অনুভব করলাম, যা আমাকে জ্যাকেট খুলতে বাধ্য করল। আইস স্কীং এবং স্লেডিং এর মধ্যে যেকোন একটা করার খুব ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সময় খুব কম থাকায় কোনোটাই করা হইনি। একজনকে ৫০ রুপি দিয়ে আইস স্কিং করার সেট গুলো নিয়ে শুধু সবাই ছবি তুলে ফিরে আসতে হয়েছিল। তবে ফিরে আসার সময় স্লেডিং করবো বলে স্থির করলাম।

ভয়ঙ্কর জঝিলা পাস

একটু পোজ দিচ্ছিলাম

সোনমার্গ জিরো পয়েন্ট

বিশ্বাস করেন একটুও শীত লাগছিল না