স্বপ্নের লাদাখ ভ্রমণ- ন্যাড়া পাহাড়ের টানে (পর্ব ১২)

বিকাল ৪ টা বেজে যাওয়াতে হোটেল থেকে ব্যাগ নিয়ে বাস টার্মিনালের দিকে হাটতে থাকি, উদ্দেশ্য জম্মু যাওয়ার বাস ধরবো। একটু পর থেকেই আমাদের নতুন প্ল্যানে ট্যুর শুরু হবে। যদিও আমাদের বাস সাড়ে পাঁচটায়, একটু আগে যাওয়ার কারণ হচ্ছে কিছু সময় আমরা বাস টার্মিনালের পাশ দিয়ে বয়ে চলা খরস্রোতা বিয়াস নদীর পাশে কাটাবো। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে আমাদের বাস খুঁজে বের করি প্রথমে। তারপর চলে যাই বিয়াস নদীর তীরে। প্রচণ্ড গতিতে আশেপাশের নিরবতা হাজার টুকরায় ভেঙে দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা নদীটি। নদীর পাশে পাথরে বসে নদীর এই তারুণ্য উপভোগ করছি। এত স্বচ্ছ পানি দেখে যে কেউই নদীর পাড়ে পাথরে বসে পা টা একটু ভিজিয়ে অলস সময় পার করতে চাইবেন। আপনি যদি এই লোভ সামলাতে না পারেন তবে পা ভিজালেই প্রথম ধাক্কাটা খাবেন, পানি এত ঠাণ্ডা যে ৫-১০ সেকেন্ডের বেশি সেই লোভ আর টিকে থাকবে না। পরে হিমালয়ের বরফ গলা হিমশীতল ঠান্ডা পানিতে ওযু করে আসরের নামাজ কসর হিসেবে ২ রাকাত পড়ে নিলাম।

ঠিক ০৫:২০ মিনিটে বাসের কাছে চলে যাই, বাসের স্টাফ বলল বাস ছাড়তে আধা ঘন্টা লেটে হতে পারে। কি আর করার, ১৫ মিনিট পরে বাস স্টাফ সবার ব্যাগ বক্সে দিতে বলেন। আমাদের ব্যাগ দিয়ে সিটে গিয়ে বসে পড়ি, সবকিছু শেষ করে বাস ছাড়ে ঠিক বিকেল ৬ টায়। বাসের কন্ডিশন খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছে না, এসি বাস কিন্তু সিটের অবস্থা খুব খারাপ। তবে এসিটা খুব ঠাণ্ডা মনে হচ্ছে, যেহেতু বাসে কম্বল নেই তাই আমার এত ঠাণ্ডার ও দরকার নেই। আমি আমার উপরের এসির লাইন বন্ধ করে রাখলাম।

যাইহোক বাস চলছে ড্রাইভারের আপন গতিতে, একটু কম গতিতে। এইদিকে সুজন ভাই কাশ্মিরী ড্রাইভার মোস্তাক ভাইকে কনফার্ম করে দিলেন যে আমরা জম্মুর বাসে উঠেছি, তিনিও যাতে কাল সকালে আমাদের জম্মু থেকে ঠিকমত পিক করে। মোস্তাক ভাই আশ্বস্ত করলেন উনি প্রায় জুম্ম চলে এসেছেন, রাতে জম্মুতে থাকবেন, তাই আমরা যাতে কোনো চিন্তা না করি। মানালিতে হয়তো বা তৃতীয়বারের মতো আসতে হতে পারে, কারণ মানালি থেকে লেহ যাওয়ার রাস্তার যে অপরূপ সৌন্দর্য আমরা মিস করলাম আবার হয়তো সেটা পুষিয়ে নিতে মানালি ফিরে আসবো কোন একদিন। মন খারাপ নিয়েই ফিরতে হলো এবার। এখন বাকি ট্যুর প্লান মতো হলেই হয়, বাকিটা আল্লাহ্ ভাল জানেন।

আমরা একজন অলরাউন্ডার ড্রাইভার পেয়েছি। গাড়িতে যখন কোনো নতুন যাত্রী উঠছে অথবা নামছেন তখন ড্রাইভার নিজে সিট থেকে উঠে দরজা খুলে দিচ্ছেন, গাড়ি থেকে নেমে যাত্রীর ব্যাগ বক্সে রেখে দিচ্ছেন অথবা বের করে দিচ্ছেন। তার এমন কাজে ঘোর সন্ধেহ হচ্ছে যে, কাল মনে হয় সকাল ৬ টায় জম্মু পৌঁছানো কখনোই সম্ভব হবে না। গত রাতে ঘুম কম হওয়াতে ক্লান্তির কারণে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি টের পাইনি। দশটার দিকে নাম নাম না জানা জায়গায় কোন এক পাঞ্জাবি ধাবা তে রাতের খাবারের জন্য বিরতি দেয়। ফ্রেশ হয়ে রুটি আর ডাল দিয়ে ডিনার সেরে আবার বাসে উঠে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকাল ৫:৪৫ এ ঘুম ভাঙ্গে, মোবাইলে তাকিয়ে দেখি এখনো মোবাইলে নেটওয়ার্ক আছে। তার মানে আমরা এখনো জম্মু-কাশ্মীর এর এলাকায় প্রবেশ করি নাই। জম্মু কাশ্মীরে বিশেষ কোন কারণে বাইরের রাজ্যগুলোর সিম কাজ করে না, তাই জম্মু কাশ্মীর এর এরিয়াতে ঢুকে গেলে ফোনে নেটওয়ার্ক থাকবে না। মনে হচ্ছে ইন্ডিয়ার মধ্যেই দ্বিতীয় কোন দেশে ঢুকতে যাচ্ছি। গুগুল ম্যাপ চেক করে দেখি আমরা এখনো পঠানকোট পর্যন্তও আসতে পারি নাই, আর আমরা জম্মু পৌঁছাব আনুমানিক সকাল ৯:৩৫ এ। তার মানে গতকাল আমার যে খারাপ আশঙ্কা ছিল সেটাই সত্যি হতে যাচ্ছে।

এদিকে বাড়িতে গিন্নিকে কল দিচ্ছি সে ফোন উঠাচ্ছে না। যদি কাশ্মীরী সিম ম্যানেজ না পারি তাহলে আগামী ৭ দিন আর বাড়িতে কথা বলতে পারবো না। সকাল ৭ টায় বাড়ি থেকে কল ব্যাক করলে একচোট ঝগড়া হয়ে যায়। যাইহোক ৭ দিনের জন্য যাতে বাসার কেউ চিন্তা না করে এই বলে লম্বা সময়ের কথাবার্তা শেষ হয় জম্মুর বর্ডার পার হবার সাথে সাথেই নেটওয়ার্ক চলে যাওয়াতে। এখন ভাল গতিতেই গাড়ি আগাচ্ছে জম্মুর খুব সুন্দর আর সোজা হাইওয়েতে। হাইওয়ের দুইপাশে বাহারি ফুল আর সবুজের সমারোহ । শেষমেষ ১৪ ঘণ্টার জার্নি শেষে সকাল ৬ টার বদলে ১০ টায় জম্মু এসে পৌছাই।